পরীক্ষা সমগ্র চর মেঘনারই
গাছের ডাব বিক্রি করেই সংসার চলে। এই চৈত্র মাসে ডাবের চাহিদাও যথেষ্ট। কিন্তু কাঁটাতারের ওপারের গ্রাম চর মেঘনার বাসিন্দা সুশীলা বিশ্বাস কয়েক দিনে একটাও ডাব বিক্রি করেননি। এই ক’টা দিন গ্রাম ছেড়ে কাজে যাচ্ছেন না সিদ্ধেন মণ্ডল। নতুন মোটরবাইকে করে তাঁকে দেখা যায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার দিনগুলোতে পাড়ার দুই ছাত্রীকে নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা কাঁটাতারের ওপারে চর মেঘনার প্রায় সব পরিবারই ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে যেন পরীক্ষায় বসেছে। প্রথমে মাধ্যমিক। তারপরে উচ্চ মাধ্যমিক। পরীক্ষার্থীদের মুখ ফুটে কিছু বলতেই হচ্ছে না। পরীক্ষার ক’দিন হাতে কোন কাজ রাখছেন না সিদ্ধেনবাবুরা। জিজ্ঞেস করলে উত্তর মিলছে, “ইতি, বিনতাকে পৌঁছে দিতে হবে না!” পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি পরীক্ষা শেষে বানি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটাও পাড়ার সিদ্ধেনকাকুর। আর, পরীক্ষাথীর্দের বাড়ি বয়ে সুশীলাকাকী দিয়ে আসছেন ডাব। বলছেন, “ক’টা দিন ছেলেপুলেগুলোর মাথাটা একটু ঠাণ্ডা থাকা দরকার।” মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক, পরীক্ষার্থীদের এ ভাবেই নিজের সন্তানের মত দেখে হোগলবেড়িয়ার চর মেঘনা।
ঘরের দাওয়ায় বসেই পড়ছে ঝর্না। নিজস্ব চিত্র।
পরীক্ষার্থীদের মুখ ফুটে কিছু বলতে হয় না তার আগেই হাজির হয়ে যায় সবকিছু। এখন রাত জেগে পড়তে হয় বলে গ্রামের কেউ আগের রাতে বাড়িতে এসে দিয়ে যায় দুধ, সকালে আবার শেষ পাতে কেউ দিয়ে যান বাড়িতে বসানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটি ভর্তি টক দই। পরীক্ষা দিতে বেরোনোর সময়েও হাজির হয়ে যান গ্রামের অনেকেই কারও হাতে গাছের পাকা কলা, কারও হাতে সদ্য জমি থেকে তুলে আনা শশা, কারও আবার দোকান থেকে কিনে আনা বিস্কুটের প্যাকেট। জোর করে পরীক্ষার্থীদের ব্যাগে তাঁরা সেগুলো গুঁজে দিয়ে বলেন, ‘‘পরীক্ষার পরে এগুলো মনে করে খেয়ে নিও কিন্তু। খিদে পেলে শরীর খারাপ করবে। দুগ্গা...দুগ্গা...’’
এবছর চর মেঘনা গ্রাম থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে ইতি মাহাতো, সুপ্রিয়া মণ্ডল, অনামিকা মণ্ডল, ঝর্না মণ্ডল, বৈশাখী মণ্ডল, বিনতা মণ্ডল, শিশির সরকার ও মিঠুন মণ্ডল বিনতা শিকারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী বাকিরা সকলেই হোগলবেড়িয়া আদর্শ শিক্ষানিকেতনের ছাত্রছাত্রী। তাদের কথায়, ‘‘ আমাদের গ্রামে চিরকাল এমনটাই হয়ে আসছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যেন গোটা গ্রামই পরীক্ষা দেয়।’’হোগলবেড়িয়া আদর্শ শিক্ষানিকেতনের প্রধানশিক্ষক বিমলকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘চর মেঘনা গ্রামের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো খুব একটা ভাল নয় গ্রামের ভৌগলিক অবস্থানটাও আর পাঁচটা গ্রামের মত নয়। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ওই গ্রামের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করতে হয়। গোটা গ্রামটাই এই সময়ে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে যায় এই সময়ে।’’
হোগলবেড়িয়ার তারকাঁটার ওপারের এক খন্ড গ্রাম চর মেঘনা সন্ধ্যার পরে তারকাঁটার গায়ে লাগানো লোহার গেট বন্ধ হয়ে গেলেই বাকি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতে থেকেও যে গ্রামের মানুষকে দিনের মধ্যে হাজারবার ভোটের সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করতে হয় গ্রামে প্রায় শ’দুয়েক পরিবারের বাস বেশিরভাগ মানুষ দিনমজুর রাস্তাঘাটের হালও খারাপ। একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। বহু অপেক্ষার পরে গত বছর গ্রামে বিদ্যু এসেছে। ফলে এমন একটা গ্রামে পরীক্ষা মানে শুধু পরীক্ষা নয় আরও বেশি কিছু।
সেটা কি? চর মেঘনার বাসিন্দা তথা করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ কংগ্রেসের উত্তম সর্দার বলেন,‘‘ আমাদের গ্রামে পরীক্ষা মানে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাওয়ার একটা পথ যেন বা!” প্রতিনিয়ত গ্রামে যে কষ্ট আমাদের ভোগ করতে হয় তা থেকে বেরোতে চান সকলেই। গ্রামের মানুষ স্বপ্ন দেখেন ও বিশ্বাস করেন যে এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের হাত ধরেই আসবে পরিবর্তন। তাই পরীক্ষাকে যুদ্ধ আর পরীক্ষার্থীদেরকে অনেকটা যোদ্ধার মতই দেখেন এখানকার মানুষ। উত্তমবাবু বলেন,‘‘ যখন আমরা পরীক্ষা দিতে যেতাম তখন আমাদেরকেও এ ভাবেই সাহায্য করত গোটা গ্রাম।” গ্রামে মেয়েদের শিক্ষার হারও তুলনামূলক বেশি। এ বার গ্রামের মোট ৮ জন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৬ জনই মেয়ে।
চম মেঘার ভালবাসার দাম দিতে ইতি, বিনতারাও তাই এখন মরিয়া।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.