অবশেষে লালবাগের মতিঝিল মসজিদ অধিগ্রহণ করল ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। অধিগ্রহণ করে মসজিদ সংস্কার ও সংরক্ষণের সিদ্ধান্তের নোটিসও তারা বুধবার মসজিদের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে ওই মসজিদ অধিগ্রহণের বিষয়টি নানা জটিলতায় ঝুলে ছিল। সমস্ত বাধা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত মসজিদ অধিগ্রহণ করায় লালবাগ জুড়ে খুশির মহল তৈরি হয়েছে। এর পরে মাস দু’য়েকের মধ্যেই ওই মসজিদ সংস্কারের কাজ শুরু হবে। তবে অধিগ্রহণের আওতার বাইরে থাকছে মসজিদের পূর্বদিক লাগোয়া অশ্বক্ষুরাকৃতি আকারের কয়েক একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা ঝিল।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা তপনজ্যোতি বৈদ্য বলেন, “মতিঝিল মসজিদ-সহ ওই চত্বরে থাকা সমস্ত স্মারক অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তবে অধিগ্রহণের আওতার বাইরে থাকছে মসজিদের পুব দিকের ঝিলটি। তবে অধিগ্রহণের পরেও ধর্মাচরণে ওই মসজিদ এলাকার মানুষ আগের মতোই ব্যবহার করতে পারবেন। আমরা মসজিদ সংস্কার করে সংরক্ষণ করব এবং মে থেকেই ওই সংস্কারের কাজ শুরু হবে।” |
তবে মতিঝিল মসজিদ অধিগ্রহণের জন্য গত ২১ বছর ধরে যে দাবি উঠছিল। কেননা, ১৯৮৯ সালে ‘মতিঝিল জামা মসজিদ উন্নয়ন’ নামে একটি কমিটি তৈরি করে এলাকাবাসী মতিঝিল মসজিদ সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জানান। কমিটির সদস্যরা ২০০৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টেরও দারস্থ হন। ওই মামলার রায়ে কলকাতা হাইকোর্ট ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণকে মতিঝিল মসজিদ অধিগ্রহণের নির্দেশ দেয়। এর পরেই অধিগ্রহণের জন্য প্রাথমিক ‘নোটিফিকেশন’ জারির সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ।
সেই মতো ২০০৯ সালের ৬ জুন প্রাথমিক ‘নোটিফিকেশন’ জারি করে তারা। তবে নিয়ম অনুযায়ী ৬০ দিন পরে চূড়ান্ত নোটিফিকেশন জারি করার আগেই মতিঝিল মসজিদ ও বাগানে কর্মরত ১২ জন কর্মী লিখিত অভিযোগ দায়ের করায় অধিগ্রহণের কাজ থমকে যায়। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জটিলতা কাটিয়ে মসজিদ অধিগ্রহণ করতে প্রায় বছর দু’য়েক লেগে গেল। ওই কমিটির সম্পাদক আবদুর রউফ খান বলেন, “আমাদের দাবি মেনে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ মতিঝিল মসজিদ অধিগ্রহণ করায় আমরা খুশি। ওই সিদ্ধান্তের ফলে ধ্বংসের হাত থেকে ঐতিহাসিক মতিঝিল মসজিদকে বাঁচানো গেল। এখন যত দ্রুত সম্ভব মসজিদ সংস্কারের কাজ শুরু করা দরকার।”
কথিত রয়েছে, মতিঝিল মসজিদে সিরাজুদ্দৌলার দাদু আলিবর্দি খাঁ নিয়মিত নমাজ পড়তে আসতেন। দাদুর হাত ধরে ছোট্ট সিরাজও মতিঝিল মসজিদে এসেছেন। ইতিহাস গবেষকেরা জানান, আলিবর্দির বড় মেয়ে নিঃসন্তান ঘসেটি বেগম সিরাজের ছোট ভাই এক্রামুদ্দৌলাকে দত্তক নিয়ে সন্তান স্নেহে পালন করতেন। অল্প বয়সে মৃত্যু হয় এক্রামুদ্দৌলার। মতিঝিল মসজিদ চত্বরেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। এক্রামুদ্দৌলার মৃত্যুর শোক সামলাতে না পেরে অসুস্থ হয়ে মারা যান ঘসেটি বেগমের স্বামী নওয়াজেস মহম্মদ খা।ঁ মতিঝিল মসজিদ চত্বরে পাশাপাশি দুজনেরই সমাধি রয়েছে।
লালবাগের বাসিন্দা ইতিহাস গবেষক রামপ্রসাদ পাল বলেন, “আলিবর্দি খাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা তথা ঘসেটি বেগমের (মেহেরুন্নেসা) স্বামী নবাব নওয়াজেস মহম্মদ খাঁ সুদৃশ্য মতিঝিল এবং ঝিলের পাড়ে ‘সাংহী দালান’ নামে এক প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। ‘সাংহী দালান’ অবশ্য এখন অবলুপ্ত। ওই মতিঝিলের পশ্চিম দিক লাগোয়া জায়গায় নওয়াজেস খাঁ ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘কালা মসজিদ’ নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা মতিঝিল মসজিদ নামে পরিচিত।” লালবাগ কোর্ট স্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ও বহরমপুর থেকে লালবাগ যাওয়ার বাইপাস রাস্তার ধারে রয়েছে এই মতিঝিল মসজিদ। রামপ্রসাদবাবু বলেন, “মুক্তোর চাষ করার জন্য মহম্মদ নওয়াজেস খাঁ ওই ঝিল সৃষ্টি করেন। ঝিল খুঁড়ে যে মাটি ওঠে, তা থেকে ইট তৈরি করা হয় এবং সেই ইট দিয়েই নির্মাণ করা হয় মতিঝিল মসজিদ।”
তবে ওই মসজিদে এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ যে ধর্মাচরণ করতেন, অধিগ্রহণের ফলে সেক্ষেত্রে কোনও বাধা-নিষেধ থাকছে না বলেও পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সূত্রে জানা গিয়েছে। তপনজ্যোতিবাবু বলেন, “মসজিদে কোরান পাঠ থেকে নিয়মিত ধর্মাচরণ করার ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। ঐতিহাসিক ওই মসজিদ সংস্কার করে ধ্বংসের হাত বাঁচানো হবে।” |