সবে বিয়ে শেষ হয়েছে। মণ্ডপে দাঁড়িয়েই পাত্রী বললেন, “বর আমাকে তালাক দিক!”
থতমত পাত্রপক্ষ। গ্রামবাসীরাও বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন! একাদশ শ্রেণির ছাত্রীটি নিজের সিদ্ধান্তে অনড়!
শেষ পর্যন্ত পাত্রীর কথাই রইল। পণ নিয়ে অশান্তির জেরে সদ্যবিবাহিতা নিজেই তালাক চেয়ে নিলেন বরের কাছ থেকে। অভিনব এই উলটপুরাণের সাক্ষী মুর্শিদাবাদের ডোমকলের প্রত্যন্ত গ্রাম সারাংপুর।
সারাংপুরের মেয়ে আজিরন খাতুনের সঙ্গে দৌলতাবাদ থানার কালুপুর গ্রামের বাসিন্দা পিয়ারুল ইসলামের শাদি ছিল বুধবার। শাদি হয়েও গিয়েছিল নিয়মমাফিক। কনেকে নিয়ে পাত্রপক্ষ রওনা দেবেন তাঁদের বাড়িতে। হঠাৎ কেটে গেল সুর। দু’বাড়ির আত্মীয়-পরিজনে ভরা মণ্ডপে দাঁড়িয়েই পিয়ারুল আর তার বন্ধুরা গলা চড়ায়। তাদের দাবি, শ্বশুরের দেওয়া মোটরবাইক পছন্দ হয়নি। আরও দামি মোটরবাইক দিতে হবে। সকলের সামনেই তারা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। সেই সঙ্গে আজিরনের পরিবারকে জড়িয়ে কটু মন্তব্যও করে বলে অভিযোগ ।
আজিরনের বাবা সাজ্জাবুল ইসলাম পেশায় রাজমিস্ত্রি। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি কষ্ট করেও দামি মোটরবাইক কিনে দিতে রাজি হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বেঁকে দাঁড়ালেন আজিরন নিজে। স্পষ্ট বলে দিলেন, এমন স্বামীর ঘর করতে রাজি নন তিনি। পিয়ারুল তাঁকে যেন তালাক দেন! পরে আজিরন বলেন, “যাঁরা বিয়ের দিনেই এমন আচরণ করেন, তাঁদের আপনজন বলে ভাবব কী করে? কিন্তু শাদি হয়ে গিয়েছিল। তাই জেদ ধরেছিলাম, স্বামী যেন আমাকে তালাক দেয়।”
আজিরনের জেদের কাছে হার মানে পাত্রপক্ষ। আজিরনের ইচ্ছাতেই তাঁকে তালাক দিতে বাধ্য হয় পিয়ারুল। বাল্যবিবাহে রাজি না হওয়া, পণ নিয়ে অশান্তির জেরে বিয়ের মণ্ডপ ছেড়ে উঠে আসার ঘটনা এর আগে একাধিক বার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। কিন্তু শাদি হয়ে যাওয়ার পরে তৎক্ষণাৎ তালাক দিতে বাধ্য করে পণপ্রথার এমনতর প্রতিবাদের কাহিনি খুব বেশি শোনা যায়নি। তালাক প্রথাকে এই ভাবে ব্যবহার করে আজিরন নতুন দৃষ্টান্তই তৈরি করলেন বলে মনে করছেন তাঁর গ্রামের মানুষ। আজিরন যে স্কুলে পড়েন, সেই সারাংপুর হাইমাদ্রাসার শিক্ষক মহম্মদ আনসার আলি বলেন, “সাধারণত ছেলেরাই স্ত্রীদের তালাক দেয়। আজিরন তাঁর স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করে প্রত্যাঘাতই করলেন।” বিয়ের রেজিস্ট্রিও হয়ে গিয়েছিল। তালাক পাওয়ার পরে এ বার আইনগত ভাবেও বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করতে চান আজিরন।
পাত্রের বাবা আতাবুদ্দিন মণ্ডল পেশায় ছোট চাষি। তিনি বলেন, “আমাদের কোনও দাবিদাওয়া ছিল না। কিন্তু কনের বাবা যখন মোটরবাইক দিলেনই, তখন আরও দামি দিলেই পারতেন। ছেলে আর তার বন্ধুরা তেমনটাই আশা করছিল।” তা সত্ত্বেও আতাবুদ্দিনের দাবি, “আমরা কেউ কিছু বলিনি। বলেছে আমার ছেলের কয়েক জন বন্ধু। তার পরে কনে যখন বিয়ে ভেঙে দিতে চাইল, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। তাই কনের কথা মতোই তাকে তালাক দিয়ে দেয় আমার ছেলে।” আতাবুদ্দিনের
বক্তব্য অবশ্য সারাংপুরের গ্রামবাসীদের কথার সঙ্গে মেলেনি। আজিরনের বিয়েতে কী ঘটেছিল বুধবার, তার সাক্ষী গোটা গ্রামের মানুষ। সারাংপুর গ্রামপঞ্চায়েত সদস্য কংগ্রেসের আব্দুল হামিদ বিশ্বাস বলেন, “পাত্র ও তাঁর বন্ধুদের আচরণে গ্রামের মানুষও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু আজিরনের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আমরা চুপচাপ মেনে নিচ্ছিলাম। তার পরে যখন আজিরন নিজেই
বেঁকে বসল, ওর কথাতেই সায় দিলাম আমরা।”
আজিরনের বাবা মেয়ের এই প্রতিবাদী আচরণ নিয়ে কী বলছেন? সাজ্জাবুলের বক্তব্য, “শাদি একবার ভেঙে গেলে, আবার বিয়ের দেওয়া অনেক সমস্যা। ওকে বারবার বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু আজিরন ছোটবেলা থেকেই জেদি।” গ্রামবাসীরা অবশ্য মনোবল জোগাচ্ছেন আজিরনদের। গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মালিকের বক্তব্য, “আজিরন যা করল, দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ অনেক সময় যে অকারণ প্রতাপ দেখায়, সেটা বন্ধ হবে। মেয়েরাও বুঝবে, প্রয়োজনে বিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়।” বর্ধিষ্ণু গ্রাম সারাংপুরে সাক্ষরতার হার ৬০ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত গ্রামেই পড়াশোনা করা যায়। তার পরে কলেজও পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যেই। হাইমাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুস সুকুর বললেন, “গ্রামে শিক্ষার হার বাড়ছে। মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার ঝোঁক ভালই। তাদের স্বাধীন মতামত তৈরি হয়েছে। বিয়ের মণ্ডপে দাঁড়িয়ে আমার ছাত্রী যে এই ভাবে প্রতিবাদ করতে পারল, তাতে গর্বিত বোধ করছি।”
হাতের মেহেন্দি এখনও রয়ে গিয়েছে। শাদি ভেঙে দিতে ভয় করল না? ভবিষ্যতের কথা মনে হল না? আজিরনের সোজা কথা, “তেমন হলে কখনও বিয়ে করবই না। পড়াশোনা চালিয়ে যাব।”
অসম্মানের ঘরকন্নার বদলে নিজের মতো করে বাঁচতেই বেশি স্বচ্ছন্দ আজিরন। |