ভুল বাড়ছে, তবে
দায় এড়াচ্ছেন কারাট
মস্ত ভুলই নিজের মুখে স্বীকার করলেন। ভুলের তালিকায় নতুন সংযোজনও করলেন। আরও একটি ভুল স্বীকার করার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখলেন। কিন্তু এত সব ভুলের কোনও দায় নিলেন না সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। পার্টি কংগ্রেসে জানিয়ে দিলেন, ইউপিএ-সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার হোক কিংবা সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা গড়া, সবটাই সামগ্রিক সিদ্ধান্ত।
আর ভুলের দায় যে হেতু তাঁর একার নয়, তাই সেই দায় মাথায় নিয়ে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোরও কোনও প্রশ্ন নেই বলেও আজ জানিয়ে দিয়েছেন কারাট। দাবি করেছেন, এমন কোনও চাপও তিনি কখনও অনুভব করেননি। পার্টি কংগ্রেসেও এখনও কেউ সেই দাবি তোলেননি। সাধারণ সম্পাদকের মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সিলমোহর বসবে কোঝিকোড়ে। এ বারে পুনর্নির্বাচিত হলেও (যা নিয়ে অবশ্য কারওই কোনও সংশয় নেই) পরের পার্টি কংগ্রেসে কারাটকে গদি ছাড়তেই হবে। কিন্তু এর সঙ্গে ব্যর্থতার কোনও সম্পর্ক নেই বলে আজ জানিয়ে দিয়েছেন কারাট।
সাধারণ সম্পাদকের পদচ্যুতি না-চাইলেও নেতৃত্বের ভুলের বহর নিয়ে কিন্তু পার্টি কংগ্রেসে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক প্রস্তাব ও রাজনৈতিক পর্যালোচনা, এই দু’টি দলিল নিয়েই এক সঙ্গে বিতর্ক হচ্ছে। সেখানে কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পঞ্জাব ও অন্ধ্রপ্রদেশের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন দলীয় নেতৃত্ব বারবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন! ভুল করার পরে তা স্বীকার করে সংশোধন করা হচ্ছে। কিন্তু আগে কেন টনক নড়ছে না! তিন রাজ্যের বাইরে কেন দলের সংগঠন প্রসারিত হল না, কেন স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার দিকে পার্টি নেতৃত্ব জোর দিচ্ছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ইউপিএ-সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার থেকেই ‘ভুল’-এর শুরু। কারাট আজ নিজেই জানিয়েছেন, “দল মনে করে, সমর্থন প্রত্যাহার জরুরি এবং সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু মনমোহন-সরকার আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় (আইএইএ) যাওয়ার আগেই সমর্থন প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। আমরা এই ভুলের কথা রাজনৈতিক পর্যালোচনায় যোগ করছি।” দলের রাজনৈতিক রিপোর্টে এমন পাঁচটি ভুল আগেই ছিল। এক, পরমাণুর চুক্তির বিরোধিতার যৌক্তিকতা কী, তা মানুষকে বোঝানো যায়নি। দুই, সমর্থন প্রত্যাহার করে মনমোহন-সরকারকে ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে নিজেদের শক্তি বিচারেই ভুল করেছিল সিপিএম। তিন, মনমোহন-সরকার যে আস্থা ভোটে সমাজবার্দী পার্টির সমর্থন আদায় করে নেবে, তা-ও আঁচ করা যায়নি। চার, লোকসভা নির্বাচনের আগে তিন-চারটি রাজ্যে অ-কংগ্রেসি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে জোট করে জাতীয় স্তরে তৃতীয় বিকল্প খাড়া করার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। পাঁচ, সেই ‘কাট-অ্যান্ড-পেস্ট’ জোট থেকে বিকল্প সরকার গঠনের ডাক দেওয়াও ভুল হয়েছিল।
আজ এর সঙ্গে যোগ হল সমর্থন প্রত্যাহারের সময় বাছার ভুল। ইউপিএ-সরকারকে আইএইএ-র অনুমোদন চাইতে যেতে দেওয়ার বিষয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে সম্মতি জানিয়েছিলেন কারাট। সীতারাম ইয়েচুরি তখন দেশের বাইরে। পরে মনমোহন-প্রণবরা যুক্তি দেন, একবার আইএইএ-তে চলে যাওয়ার পর আর পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। দলের মধ্যে আরেকটি মত হল, পরমাণু চুক্তির বদলে মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয় নিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। কারাট বলেন, “এটা এখনও ভুলের তালিকায় নেই। তবে পার্টি কংগ্রেস এখনও শেষ হয়নি। তার পরেই ভুলের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হবে।” অর্থাৎ আরও একটা ভুল স্বীকারের দরজা খোলা রইল। আর সব ভুল স্বীকার করে কারাটের মন্তব্য, “সব কিছুর পরেও পরমাণু চুক্তির রূপায়ণ আটকাতে না-পারাটা আমার একমাত্র দুঃখ।”
দুঃখপ্রকাশে অবশ্য চিঁড়ে ভিজছে না। আজ পার্টি কংগ্রেসের রুদ্ধদ্বার আলোচনায় মহারাষ্ট্রের নেতা নরসাইয়া আদম যুক্তি দিয়েছেন, সমর্থন প্রত্যাহার সঠিক ছিল। আইএইএ-তে যাওয়ার আগেই সমর্থন প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। কিন্তু আইএইএ-তে যেতে দেওয়াটা যে ভুল ছিল, সেটাও মানতে হবে। কেন এ বিষয়ে সম্মতির ফলাফল আগাম আঁচ করা গেল না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। কর্নাটকের জি ভি শ্রীরামা রেড্ডির কটাক্ষ, পার্টি একটা ভুল করছে, তার পরে শোধরাচ্ছে। ভুল করার আগে সতর্ক হচ্ছে না। প্রকাশ কারাটের আমলে এক দিকে সিপিএম জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে তিন রাজ্যের বাইরেও পা ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। বিতর্কে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজস্থানের হেতরাম বেনিওয়াল, পঞ্জাবের রঘুনাথ সিংহরা। তাঁদের বক্তব্য, হিন্দি বলয়ে প্রভাব ছড়াতে গেলে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতে হবে। যেমনটা রাজস্থানে হয়েছে। সেখানে দলের বিধায়ক সংখ্যা এক থেকে বেড়ে তিন হয়েছে। এখন তিনকে বাড়িয়ে দশ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ভরাডুবির পর অভিযোগ উঠেছিল, কেন্দ্রে সমর্থন প্রত্যাহার করে কারাট রাজ্যে তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোটের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছেন। আলিমুদ্দিনকে তারই মাসুল চোকাতে হয়েছে। দিল্লির এ কে জি ভবন থেকে পাল্টা অভিযোগ ওঠে, পশ্চিমবঙ্গে হারের কারণ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-সহ রাজ্যের সাংগঠনিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা। দলের মধ্যে কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে ভুলের দায়ও কি শুধুই পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের? কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে তখন কেন সতর্ক করা হয়নি? আজ পার্টি কংগ্রেসে অন্ধ্রের শ্রমিক নেতা এস বীরাইয়া যুক্তি দিয়েছেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সব দায় পশ্চিমবঙ্গের উপর চাপানো উচিত নয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও একই রকম দায়ী। আজ কারাটও সে কথা মেনে নিয়েছেন। তাঁর স্বীকারোক্তি, পলিটব্যুরো মনে করেছিল গাড়ির কারখানা হলে রাজ্যের শিল্পায়নে গতি আসবে। উপযুক্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিলে জমির মলিকরাও রাজি হবেন। শতকরা আশি ভাগ কৃষক রাজিও ছিলেন। কিন্তু বাকি কুড়ি ভাগের আপত্তিতে যে প্রকল্প আটকে যাবে, তা একেবারেই আঁচ করা যায়নি।
কারাটের স্বীকারোক্তিও তাঁর সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে পারছে না। তাঁরা বলছেন, কারাট নিজের কথা বলছেন না, গোটা পলিটব্যুরোকে টানছেন। ব্যক্তিগত দায় এড়িয়ে সামগ্রিক দায়ের যুক্তি দিচ্ছেন। সবটাই ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার কৌশল। আর কারাটের ‘আত্মবিশ্বাসী’ জবাব, “আর তিন দিন পরেই তো নতুন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হবে। আমাকে কেউ সরাতে চাইলে সেখানেও দাবি তুলতে পারেন। এই তিনটে দিন অপেক্ষা করেই দেখুন না!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.