|
|
|
|
|
পাশে ভিন্ রাজ্যও |
অনুপস্থিত বুদ্ধের ‘ছুটি’ মঞ্জুর দলে, চর্চায় বাংলা
সন্দীপন চক্রবর্তী • কোঝিকোড় |
|
পার্টি কংগ্রেসে অনুপস্থিতির জন্য তাঁর ‘ছুটি’ মঞ্জুর করল দল! পরবর্তী পলিটব্যুরো থেকে তাঁর ‘ছুটি’ মিলবে কি না, তার জন্য অপেক্ষা আরও দিন তিনেকের।
একটা ‘মঞ্জুর’-হওয়া ছুটি এবং আর একটা ‘ছুটি’র বাসনা এই দুই নিয়ে কোঝিকোড়ে চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!
শারীরিক অসুস্থতার জন্য পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত হতে না-পারার কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর হাত দিয়ে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনুমোদন করিয়ে নিজেই তা কংগ্রেসে জানিয়ে দিয়েছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। পরে যিনি বলেছেন, “শারীরিক সমস্যার জন্য ওঁর পক্ষে এই মুহূর্তে লম্বা সফর করা সম্ভব নয়। এখানে আসতে না-পারায় উনি খুবই দুঃখিত। কেন্দ্রীয় কমিটি এই অনুপস্থিতির জন্য ওঁকে ছুটি মঞ্জুর করেছে।”
তা হলে কি এই শারীরিক সমস্যার জন্যই পলিটব্যুরোর নিয়মিত সদস্য হিসাবে আর দেখা যাবে না বুদ্ধবাবুকে? কারাটের জবাব, “আর দিন তিনেক অপেক্ষা করলেই তো সব জল্পনার অবসান হবে!” পার্টি কংগ্রেসের শেষ লগ্নে ওই সময়েই সিপিএমের নতুন পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন হওয়ার কথা।
পলিটব্যুরো সূত্রের খবর, নতুন কমিটিতে বুদ্ধবাবুকে রাখা নিয়ে দলের অন্দরে স্পষ্ট কোনও মত কোঝিকোড়ে এসে এখনও প্রকাশ করেননি কারাট। দলের একাংশ (যারা তুলনায় ‘কট্টরপন্থী’ এবং ‘কারাট-ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত) বুদ্ধবাবুকে পলিটব্যুরোর ‘আমন্ত্রিত সদস্য’ করে প্রয়াত জ্যোতি বসুর সমান মর্যাদা দেওয়ার বিপক্ষে। তাঁদের মত, শারীরিক অসুস্থতার জন্যই পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে একেবারে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হোক। আবার সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বে একাংশ লড়ছেন বাংলায় দলের ‘মুখ’ বুদ্ধবাবুকে কোনও ‘সাম্মানিক’ পদে হলেও রেখে দেওয়ার জন্য।
স্বয়ং কারাট তাঁর তাস এখনও গোপন রাখছেন। আলিমুদ্দিনের চার দেওয়ালে বন্দি বুদ্ধবাবুকে কোঝিকোড়ে তিনি কি ‘মিস্’ করছেন?
পার্টি কংগ্রেসের অবসরে আজ বিকালে কারাটের স্পষ্ট উত্তর, “হ্যাঁ, তা করছি। বুদ্ধবাবু আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কমরেড এবং সতীর্থ। তবে কলকাতায় বসেও উনি পার্টি কংগ্রেসের খবর রাখছেন। আমরাও যোগাযোগ রাখছি।” ঈষৎ উদাস কণ্ঠেই কারাট বললেন, “পার্টি কংগ্রেসে ওঁর আসা নিয়ে আমার সঙ্গে এত আলোচনা হল। আসার চেষ্টা করবেন বলেছিলেন। শরীর ঠিক না-থাকলে আর কী করা যাবে?”
কলকাতায় বসে ‘খবর’ রাখলে বুদ্ধবাবু জেনে খুশি হবেন, পার্টি কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক দলিল এবং রাজনৈতিক পর্যালোচনা রিপোর্ট নিয়ে দিনভর আলোচনায় ভিন্ রাজ্য থেকে সমর্থন এসেছে তাঁর শিল্পায়নের প্রচেষ্টার জন্য। সিপিএম সূত্রের খবর, এ দিনের রুদ্ধদ্বার আলোচনায় বিহারের প্রতিনিধি সর্বোদয় শর্মা প্রশ্ন তুলেছেন, নন্দীগ্রামের কথা তুলে কেন শুধু পশ্চিমবঙ্গকে দলের ভিতরে ‘নিশানা’ করা হবে? বাংলা চেয়েছিল শিল্পায়নের পথে এগোতে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি-সহ সর্ব স্তর থেকে সেই প্রচেষ্টায় ‘অনুমোদন’ ছিল। ওই পথে এগোতে গেলে কী সমস্যা আসতে পারে, সেগুলো তা হলে সামগ্রিক ভাবে দলের আগেই ভাবা উচিত ছিল। ঠিক যে মত বুদ্ধবাবু নিজেও পোষণ করেন। ছত্তীসগঢ়ের বি সান্যাল সওয়াল করেছেন, দেশের জবরদস্ত ‘লাল দুর্গ’ বাংলার ঘাড়ে (অর্থাৎ আলিমুদ্দিন) দোষারোপ একেবারেই ‘অর্থহীন’। হিমাচল প্রদেশের কুশল ভরদ্বাজের মত, লাল ঝান্ডা রক্ষা করার জন্য বাংলা যে লড়াই লড়ছে, তার পাশে না-দাঁড়ালে গোটা দেশেই সিপিএমের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
প্রতিনিধিদের আলোচনা-পর্বে বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র বা গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য নেত্রী সাবিত্রী মজুমদারের বক্তৃতায় ‘পরিবর্তনে’র বঙ্গে বামেদের উপরে আক্রমণের খতিয়ান শুনে অসমের অনন্ত ডেকা, পঞ্জাবের রঘুনাথ সিংহ বা ঝাড়খণ্ডের জি কে বক্সীরা বুদ্ধবাবুদের রাজ্যের প্রতি ‘সহমর্মিতা’ জানিয়ে বলেছেন, এই অন্ধকারের দিন পেরিয়ে আলোয় ফেরা সম্ভব হবেই। দিল্লির অনুরাগ সাক্সেনা প্রশ্ন তুলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে ভবিষ্যতের শিল্পায়নের ‘রোডম্যাপ’ কেন এখন থেকেই তৈরি করে ফেলা হবে না?
স্বয়ং কারাটও থেকেছেন বুদ্ধবাবুর পাশে। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে গোলমাল পশ্চিমবঙ্গে দলের পতনের অন্যতম কারণ বলে মেনেও কারাট ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে নন্দীগ্রামে আগে হস্তক্ষেপের প্রশ্নই ছিল না। কারণ, ওখানে জমি নেওয়াই হয়নি।
আর সিঙ্গুরে মাত্র ২০% লোকের বিরোধিতা যে একটা গোটা প্রকল্পকে আটকে দিতে পারে, পলিটব্যুরো ধারণাই করতে পারেনি!”
বস্তুত, বুদ্ধ-হীন বঙ্গ সিপিএমের সর্বভারতীয় মঞ্চে ‘সক্রিয়’ থাকার লড়াই কোঝিকোড়ে জারি রয়েছে পুরোদমেই। অধিবেশনের ভিতরে এ দিন যেমন ঝাড়গ্রামের সাংসদ পুলিনবিহারী বাস্কে আদিবাসী-তফসিলিদের জন্য তাঁদের রাজ্যে বামেদের কাজের উল্লেখ করে গোটা দেশেই আদিবাসী কল্যাণে এগোনোর কথা বলেছেন, তেমনই বাইরে সারা দেশের সংবাদমাধ্যমের সামনে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র চেষ্টা চালিয়েছেন গত কয়েক মাসে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের এবং সার্বিক ভাবে ‘গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণে’র কাহিনি তুলে ধরার। দ্বিতীয় দিনে যে চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তার মধ্যেও অন্যতম কৃষক আত্মহত্যা ও কৃষি-সঙ্কট। পশ্চিমবঙ্গে বামেরা ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পরে কৃষি ক্ষেত্রের ঘনীভূত সঙ্কট এবং কৃষক আত্মহত্যার কথা সেখানে স্থান পেয়েছে। যা সম্ভবত ‘স্বস্তি’ই দেবে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে।
আর আলোচনার প্রথম পর্বে বুদ্ধবাবুর সহপাঠী এবং বিগত মন্ত্রিসভার সতীর্থ অসীম দাশগুপ্তের সওয়াল, কর্মচারীরা কোনও ভাবেই ধর্মঘটের অধিকার (অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে) ছেড়ে দেবে না। সমাপতন এই যে, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ধর্মঘটের বিরুদ্ধেই সওয়াল করে দলের বিরাগভাজন হওয়া বুদ্ধবাবুর ‘মার্জিত’ অবস্থান (সম্প্রতি দলীয় বৈঠকে ধর্মঘট-বিরোধী মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন বুদ্ধবাবু) পার্টি কংগ্রেসে পেশ হয়ে গেল তাঁর অনুপস্থিতিতে। তাঁরই সতীর্থের মাধ্যমে! |
|
|
|
|
|