|
|
|
|
জনসংযোগ বাড়ানোর নির্দেশ নেতা-কর্মীদের |
|
এখনই মানুষের মন বদলের
আশা দেখছে না সিপিএম
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
|
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ময়দানে নামলেও মাত্র দশ মাসের মধ্যেই ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ স্বপ্ন দেখছেন না সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁদের মতে, রাজ্যে এখনও এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যাতে মানুষ আবার বামেদেরই বিকল্প বলে ভাবছেন।
সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনায় এক দলীয় বৈঠকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছেন, একটা সরকারকে বিচার করার জন্য ১০ মাস কখনওই যথেষ্ট নয়। আগামী কালই সরকার চলে যাচ্ছে না। বস্তুত সিপিএম পলিটব্যুরো এবং রাজ্য নেতৃত্বের মতে, মমতার পিছনে এখনও গ্রাম বাংলার মানুষের একটা বিরাট অংশের সমর্থন রয়েছে। পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড অথবা সংবাদমাধ্যমের উপরে নিয়ন্ত্রণ জারির চেষ্টা ঘিরে শহুরে মধ্যবিত্ত জনসমাজের মনে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ঠিকই। কিন্তু তার প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হবে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতাই বলছে, টাটারা সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে শহরের মানুষের একটা বড় অংশ তৃণমূলের প্রতি বিরূপ হলেও ভোটের বাক্সে তার কোনও প্রভাবই পড়েনি।
ঠিক সেই কারণে, পার্টি কংগ্রেসের আগে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু জেলার নেতাদের বার্তা দিয়েছেন, সম্প্রতি সরকারের বেশ কিছু কার্যকলাপ সম্পর্কে নাগরিক সমাজের একাংশের প্রতিক্রিয়া দেখে কোনও রকম আত্মতুষ্টিতে ভুগবেন না। এই সব ঘটনার জেরে সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছে, বা সিপিএমের দিকে ফিরে এসেছে, তা কিন্তু নয়। পলিটব্যুরোর সামনে রাজ্য নেতৃত্বের যে রাজনৈতিক মূল্যায়ন বিমানবাবু জমা দিয়েছেন, তাতেও বলা হয়েছে: মাত্র দশ মাসে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যাতে ৩৪ বছরের সিপিএম শাসন সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে জনসংযোগের উপরেই জোর দিচ্ছেন সিপিএম নেতারা। বুদ্ধবাবু দলীয় কর্মীদের ওই সভায় বলেছেন, বামেদের মানুষের কাছেই ফিরে যেতে হবে। তাঁরাই ‘বিচার’ করে নেবেন তাঁদের অভিজ্ঞতায়। বিমানবাবুও সম্প্রতি দিল্লিতে একটি আদিবাসী সম্মেলনে যোগ দিতে এসে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার আদিবাসী নেতাদের বলেছেন, “আপনারা গ্রামে ফিরে গিয়ে শুধু দলীয় কর্মী নয়, অন্যদের সঙ্গেও মেলামেশা বাড়ান। সম্পর্ক গড়ে তুলুন।”
কিন্তু কাজটা যে সহজ নয়, যে মানুষেরা মুখ ফিরিয়েছেন তাঁদের ফিরিয়ে আনতে যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, সেটা সিপিএম নেতারা জানেন। বিমান-বুদ্ধ থেকে শুরু করে সূর্যকান্ত মিশ্র, নিরুপম সেন, গৌতম দেবের মতো নেতারা সকলেই মনে করেন, এখন দীর্ঘমেয়াদি রণকৌশল নিতে হবে। চটজলদি কিছু হওয়ার নয়।
রাজ্যে এর পর বড় ভোট পঞ্চায়েত নির্বাচন। যা হওয়ার কথা আগামী বছর মে মাসে। এখনও পর্যন্ত সিপিএমের রিপোর্ট হল, সেই ভোটে তৃণমূল তাদের তুলনায় অনেক ভাল ফল করবে। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের সর্বত্র প্রার্থী দিতে পারবেন কিনা, তা নিয়েই সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের সংশয় রয়েছে।
চলতি পার্টি কংগ্রেসে যে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করা হচ্ছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে যে রাজ্য সংগঠনে বিরাট ধস নেমেছে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে থাকতেই এই ধস নামা শুরু হয়েছিল। গত দশ মাসে সাংগঠনিক অবক্ষয়ের চিত্রটি বদলায়নি। ওই রিপোর্ট বলছে, ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পার্টি সদস্য ছিল ৩ লক্ষ ২১ হাজার। এ বার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লক্ষ ১৪ হাজার। সদস্য কমেছে সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠনেও। ২০০৭ সালে সারা দেশে ডিওয়াইএফের সদস্য ছিল ১ কোটি ৭১ লক্ষ। এ বার তা কমে হয়েছে ১ কোটি ৩০ লক্ষের কাছাকাছি। আর এসএফআই-এর সদস্য সংখ্যা ১৬ লক্ষের কাছাকাছি থেকে কমে হয়েছে ১৩ লক্ষ।
সিপিএম নেতাদের বিশ্লেষণ হল, নন্দীগ্রামের ঘটনার পর সংখ্যালঘু ও তফসিলি সম্প্রদায় তাঁদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। এই শ্রেণির মানুষদের সমর্থন এখনও মমতার পক্ষেই রয়েছে। সিপিএমের পক্ষে এমন চাঞ্চল্যকর কিছু করা সম্ভব হয়নি, যাতে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। উল্টে ইমামদের সভায় ঢালাও ‘উপহার’ ঘোষণা করে মমতা তাঁদের আরও কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। দলের অন্দরে আলোচনায় এই ঘোষণাকে ‘তোষণের রাজনীতি’ বলে সমালোচনা করলেও প্রকাশ্যে তার নিন্দা করতে পারছে না সিপিএম।
তবে গ্রাম বাংলায় ক্রমশ বেড়ে চলা তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সিপিএম নেতাদের একটু আশার আলো দেখাচ্ছে। তাঁদের মতে, ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ‘স্বাভাবিক’ পরিণতি হিসেবে যে ‘লুম্পেন’ সম্প্রদায় সিপিএমের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল, পালাবদলের পরে তারা এখন তৃণমূলের দিকে ঢলেছে। সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট থেকে বিমান বসু সকলেই এখন বলছেন, এই বদ রক্ত বেরিয়ে যাওয়াই ভাল। তাতে দলের সদস্য সংখ্যা কমবে ঠিকই, কিন্তু গুণগত মান বাড়বে। যদিও জেলার নেতাদের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিমত আছে। তাঁদের কারও কারও বক্তব্য, ওই লুম্পেন উপাদানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলে নির্বাচনে জেতাই যাবে না। তা ছাড়া, কারাট পার্টি কংগ্রেসে যতই বলুন যে, ভয় দেখিয়ে বাংলার পার্টিকে দমানো যাবে না, বাস্তবে তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসের’ মোকাবিলা করে গ্রামেগঞ্জে দল ধরে রাখতে এই ধরনের ডাকাবুকো নেতা-কর্মী দরকার বলেই তাঁদের মত।
পার্টি কংগ্রেসে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আলোচ্য নয়। কিন্তু সাংগঠনিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গেই দল এখনও সব চেয়ে শক্তিশালী। তাই এ রাজ্যের পরিস্থিতি জানতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিনিধিরা স্বাভাবিক ভাবেই আগ্রহী। সেই সব প্রতিনিধিদের কাছে দলের বক্তব্য, আপাতত সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে বিরোধী
দলের ভূমিকা সুষ্ঠু ভাবে পালন করতেই তারা আগ্রহী। মমতার ভুল সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপগুলিকে মূলধন করে প্রচার অভিযানকে তুঙ্গে তুলে হতাশ দলীয় কর্মীদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। পাশাপাশি নজর রাখা হচ্ছে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কের উপরেও। রাজ্যে কংগ্রেস কার্যত নখদন্তহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতীয় স্তরে দু’দলের পারস্পরিক সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, তার দিকে নজর রাখা হচ্ছে।
কিন্তু সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের সামনে এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড় কাজ হল, মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ভোটারদের আস্থা পুনরায় অর্জন করা। তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠা। কাজটা যে সহজ নয়, বুদ্ধ-বিমান তা বিলক্ষণ জানেন। |
|
|
|
|
|