|
|
|
|
অস্ত্র সেই ১৮৯৪-এর আইন |
‘অনিচ্ছুকদের’ জমির দখল নিচ্ছে তৃণমূল জেলা পরিষদ |
অমিত কর মহাপাত্র • পটাশপুর |
বিদ্যুতের সাব-স্টেশন গড়তে ১৮৯৪-এর জমি অধিগ্রহণ আইনে কৃষিজীবীর আপত্তি ‘অগ্রাহ্য করে’ জমি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূলের জেলা পরিষদ! তা-ও আবার নন্দীগ্রামের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে।
সিঙ্গুরেও এই আইন-বলেই জমি নিয়েছিল বাম সরকার। নন্দীগ্রামে এই আইনেই জমি অধিগ্রহণের নোটিস জারি হয়েছিল। বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল তৃণমূল। সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরতের দাবিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২৬ দিনের অনশন, দীর্ঘ আন্দোলন। যার জেরে সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্পই গুটিয়ে নিতে হয়েছে টাটাদের। আর নন্দীগ্রামে বয়ে গিয়েছে রক্তস্রোত।
২০০৬ সালে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের আগে, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদে বামেরা যখন ক্ষমতাসীন, সে সময়েই পটাশপুর-২ ব্লকের সাউৎখণ্ড গ্রাম পঞ্চায়েতের সাউৎখণ্ড মৌজায় ৩৩/১১ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুতের সাব-স্টেশন গড়তে ৬৭ ডেসিমেল রায়তি জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি হয় ২০০৯-এর ৩০ সেপ্টেম্বর। তখন জেলা পরিষদে তৃণমূলই ক্ষমতায়। ৪ পরিবারের ১২ জন ওই জমির অংশীদার। তাঁদের দাবি, ১৮৯৪-র আইনে সরকার নির্ধারিত ক্ষতিপূরণে (৩,৭০০ টাকা প্রতি ডেসিমেল) তাঁরা যে জমি দিতে নারাজ, প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন সে কথা। জমির বাজারচলতি দর (ডেসিমেল-পিছু অন্তত ২০-২৫ হাজার টাকা) এবং পরিবারপিছু এক জনের চাকরি দাবি করেন তাঁরা। সেই দাবি পূরণ হয়নি। জমিও হাতে আসেনি প্রশাসনের। সাব-স্টেশনও হয়নি। |
|
সাউৎখণ্ডে এই জমিরই দখল নিতে চলেছে জেলা পরিষদ।-নিজস্ব চিত্র |
গত ৩০ মার্চ তৃণমূল পরিচালিত জেলা পরিষদের সভায় অবশ্য ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা আদালতে জমা রেখে ওই ৬৭ ডেসিমেল জমির ‘দখল’ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঠিক যে ভাবে বাম-আমলে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুকদের জমির ক্ষতিপূরণ-অর্থও জমা করা হয়েছিল আদালতে।
তৃণমূল পরিচালিত জেলা পরিষদ এখন ঠিক সেই যুক্তিই দিচ্ছে যা আগের আমলে বাম মন্ত্রী-নেতারা দিয়েছেন। যুক্তিটি হল, ১৮৯৪-র আইনে জমি-অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের অতিরিক্ত বা চাকরির দাবি বিবেচনার সুযোগ নেই। আগের আমলের শাসকদের মতোই ‘উন্নয়নে বাধা’র অভিযোগও তুলছেন এখনকার শাসকেরা!
পটাশপুরের সাউৎখণ্ড মৌজার ওই জমির অংশীদার চারটি কৃষিজীবী পরিবারের পক্ষে পুঁটিবালা করণ, সুরেশচন্দ্র করণ, চিত্তরঞ্জন জানা, সতীশ জানাদের বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীই তো বলেছেন জোর করে জমি নেওয়া হবে না। আমাদের জেলাতেই নন্দীগ্রামে রেলের প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের সময়েও তিনি বাড়তি দর এবং পরিবারপিছু চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। তা হলে আমরা কেন বঞ্চিত হব?” পরিবারগুলির অভিযোগ, “জমি না দেওয়ায় নানা ভাবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।”
জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি তথা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক মামুদ হোসেনের অবশ্য দাবি, “জমির জন্য কোনও জোরাজোরি করা হচ্ছে না। ওঁরা অনিচ্ছুক চাষিও নন। ক্ষতিপূরণ বাবদ আমরা যা দিতে চাইছি, তার থেকে ওঁদের দাবি কিছুটা আলাদা, এটুকুই যা সমস্যা।” মামুদের অভিযোগ, “একটি রাজনৈতিক শক্তিই এ ব্যাপারে বাগড়া দিচ্ছে। তারা চাইছে যেন উন্নয়ন না হয়।” এলাকার অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি সিপিএমের প্রতাপদিঘি জোনাল কমিটির সম্পাদক কালীপদ দাস মহাপাত্র বলেছেন, “এলাকার উন্নয়নের প্রশ্নে চাষিদের যেমন সরকারের পাশে দাঁড়ানো উচিত, তেমনই চাষিদের দাবিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার জেলা পরিষদ, প্রশাসনের। মুখ্যমন্ত্রীই তো জমি দিলে বাড়তি দাম, চাকরির কথা বলেছিলেন। সুযোগ থাকলে তেমন ব্যবস্থা করাটাই মানবিক।”
সহ-সভাধিপতি অবশ্য জানিয়েছেন, গত ২৯ মার্চ জেলা পরিষদের সভাধিপতি, বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ, বিদুৎ দফতরের আধিকারিকেরা মিলে ওই জমি পরিদর্শন করেন। পর দিন তাঁদের সঙ্গে জেলাশাসকের বৈঠকেই জমির ক্ষতিপূরণ-অর্থ জমা রেখে ‘দখল’ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত জেলাশাসকের কাছেই গচ্ছিত থাকবে ক্ষতিপূরণ-অর্থ। তার পরে তা চলে যাবে আদালতের জিম্মায়। তখন সেখানেই আবেদন করে ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে হবে জমি-মালিকদের। |
(সহ প্রতিবেদন: আনন্দ মণ্ডল ও সুব্রত গুহ) |
|
|
|
|
|