|
|
|
|
মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে তা হলে কী বলেছিলেন মুখ্যসচিব |
টেন্ডারের প্রশ্নই নেই, নয়াগ্রাম সেতুর বরাত রাজ্য-সংস্থাকে |
দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
তিনি রাজনীতির মানুষ। তাই সত্যি কথা না-ও বলতে পারেন। রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাদের ‘সাক্ষী’ রেখে জঙ্গলমহলের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার হাল-হকিকত জানাতে গিয়ে চলতি বছরের গোড়ায় এমনই মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দিনটা ছিল ১২ জানুয়ারি। জঙ্গলমহল উৎসবের উদ্বোধন করতে ঝাড়গ্রামে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর সেই মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, সুবর্ণরেখার উপরে প্রস্তাবিত কেশিয়াড়ি-নয়াগ্রাম সেতুর কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। টেন্ডারও হয়ে গিয়েছে। মমতার অনুরোধে রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষও হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে জঙ্গলমহলের মানুষকে জানিয়েছিলেন সেই ‘তথ্য।’
কিন্তু ঘটনা হল, টেন্ডার তো ডাকেইনি রাজ্য সরকার!
পূর্ত ও অর্থ দফতরের সুপারিশ মেনে ভসরাঘাট সেতুর বরাত দেওয়া হয়েছে ম্যাকিনটশ বার্ন-কে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “সংস্থাটি যেহেতু পুরোদস্তুর সরকার অধিগৃহীত, তাই ওদের বরাত দিতে টেন্ডার ডাকার প্রয়োজন পড়ে না।” মুখ্যমন্ত্রীর অফিস সূত্রের খবর: দিন পাঁচেক আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংশ্লিষ্ট ফাইলে সই করেছেন। আগামী ১৮ এপ্রিল রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি ওঠার কথা। |
|
১২ জানুয়ারি জঙ্গলমহল উৎসবের মঞ্চে মুখ্যসচিবকে দিয়ে নয়াগ্রামের সেতুর
টেন্ডার হওয়ার কথা ঘোষণা করাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ফাইল চিত্র |
নয়াগ্রাম সেতুর শিলান্যাসের পর থেকেই প্রকল্পটি রূপায়ণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের উপায় খোঁজা হচ্ছিল। টানাটানির সংসারে বরাদ্দ জোগাড় করতে না-পেরে রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটিকে বর্ডার রিজিওন গ্রান্ট ফান্ড (বিআরজিএফ)-এর আওতায় এনে কেন্দ্রীয় অর্থে সেটি বাস্তবায়িত করার পথে হাঁটছে। মুখ্যমন্ত্রীর অফিস-সূত্রের খবর: প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১৭০ কোটি টাকা। বস্তুত, পশ্চিম মেদিনীপুরে ওই সেতু নির্মাণের জন্য টেন্ডার ডাকার পরিকল্পনা রাজ্যের কখনওই ছিল না বলে সরকারি সূত্রের দাবি। প্রশাসনের এক মুখপাত্রের কথায়, “টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনেকটা সময় নষ্ট হয়। আর এ ক্ষেত্রে কাজটা যেহেতু প্রায় দু’শো কোটি টাকার, তাই জাতীয় স্তরে টেন্ডার ডাকা বাধ্যতামূলক ছিল।”
এর পরিপ্রেক্ষিতে, কার্যত সময় বাঁচাতেই ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশ সেতু নির্মাণের ভার সরকার-অধিগৃহীত ম্যাকিনটশ বার্নের হাতে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন বলে সরকারি নথিতে জানানো হয়েছে। ওঁদের বক্তব্য ছিল, নানা ধরনের সেতু নির্মাণে ম্যাকিনটশের অভিজ্ঞতা প্রচুর, কাজের মানও ভাল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে হলে টেন্ডার প্রক্রিয়া এড়িয়ে তাদেরই বরাত দেওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেন অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার। মহাকরণ সূত্রের খবর: পূর্ত দফতর (সড়ক)-এর যুগ্ম সচিব (কারিগরি), চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ-এর স্বাক্ষর সংবলিত সুপারিশপত্রটি সরকারের কাছে জমা পড়েছিল গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর। |
|
সুবর্ণরেখা পেরোতে এখনও ভরসা এই অস্থায়ী সেতু। কিংশুক আইচের তোলা ছবি। |
সে সুপারিশ মেনেও নিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর অফিস। এবং সেখানকার সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরেই ম্যাকিনটশ বার্ন ইচ্ছেপত্র (এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট) জমা দেয় সরকারকে। মুখ্যমন্ত্রীর অফিস সূত্রের খবর: মমতা যে দিন (১২ জানুয়ারি) ঝাড়গ্রামে ভসরাঘাট সেতুর ‘টেন্ডার হয়ে যাওয়ার’ কথা ঘোষণা করেছিলেন, তার প্রায় দু’মাস আগে, গত বছরের ১৪ নভেম্বর ইচ্ছেপত্র জমা দিয়েছিল সংস্থাটি। কিন্তু নির্মাণ খরচের যে প্রাথমিক হিসেব তারা দাখিল করে, পূর্ত দফতর সেটাকে ‘একটু বেশি’ই মনে করেছিল। মুখ্যমন্ত্রীর অফিস তাই সুপারিশ করে, বিষয়টি অর্থ দফতর বিবেচনা করুক। অর্থ দফতর এ জন্য তিন সদস্যের কমিটি গড়ে। কমিটি ম্যাকিনটশেরই পক্ষে ‘রায়’ দেয়।
আর এই ফাইল চালাচালির মধ্যেই জঙ্গলমহলে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, ‘সেতুর টেন্ডার হয়ে গিয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে সে দিন মমতা এ-ও বলেছিলেন, “আমি রাজনীতির লোক। মিথ্যে কথা বলতে পারি। কিন্তু মুখ্যসচিব সরকারি আধিকারিক। উনি সত্যি কথা বলবেন।” তার পরেই মুখ্যসচিব সমরবাবুকে উদ্দেশ করে মমতা বলেছিলেন, “আপনি একটু আসুন, প্লিজ। নয়াগ্রামে সেতুর টেন্ডার হয়েছে কি না বলুন।” সমরবাবু ইতস্তত করে নিজের আসন ছেড়ে মঞ্চের সামনে এগিয়ে আসতেই তাঁর হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মাইক্রোফোনে সমরবাবু বলেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে জানাচ্ছি, সেতুর টেন্ডার হয়ে গিয়েছে।”
এ কথা বলার প্রয়োজন পড়েছিল কেন? রাজ্য প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য: মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরে দু’দফায় জঙ্গলমহলে গিয়ে সেখানকার মানুষকে উন্নয়নের বিবিধ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন মমতা। গত বছরের ১৫ অক্টোবর ঝাড়গ্রামে দাঁড়িয়ে তিনি যে সব প্রকল্পের শিলান্যাস করেন, ভসরাঘাট সেতু ছিল সেই তালিকায়। কিন্তু তার পরে প্রকল্পগুলির কাজ বিশেষ এগোয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। রাজ্য প্রশাসনের একাংশ মনে করছেন, ওই সমালোচনার জবাব দিতে, এবং পাশাপাশি নয়াগ্রাম সেতুর কাজ কত দ্রুত এগোচ্ছে তা বোঝাতে গিয়েই ১২ জানুয়ারি পুলিশ-প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাদের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে টেন্ডার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
আনন্দবাজার সে সময়ে জানিয়েছিল, নয়াগ্রামে সেতুর মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। সরকারি নথি বলছে, তখন ওই কাজেরই টেন্ডার হয়ে গিয়েছিল, যা ডেকেছিল পূর্ত দফতরের মেদিনীপুর হাইওয়ে সাব ডিভিশন(১)-এর অধীন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের অফিস। অফিসের ২০১১-র ২৫ নভেম্বর তারিখের নথিতে (মেমো নম্বর ৬৭০) দেখা যাচ্ছে, টেন্ডার পেশের দিন ধার্য হয়েছিল তিন দফায় ১২, ১৩ ও ১৬ ডিসেম্বর। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা। প্রশাসনিক মহলের একাংশের ধারণা, ১২ জানুয়ারির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যসচিব এই টেন্ডারের কথাই বলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু সাকুল্যে সাড়ে চার লক্ষ টাকার মাটি পরীক্ষার কাজের সঙ্গে প্রায় দু’শো কোটির সেতু-প্রকল্পকে মুখ্যসচিব স্তরের কোনও আমলা ‘গুলিয়ে ফেলবেন’ কেন, সে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। |
|
|
|
|
|