|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
গ্রামপঞ্চায়েত কি তবে এলেবেলে হয়ে যাবে |
জেলাশাসক, বি ডি ও প্রমুখ সরকারি কর্মী গরিবের জন্য প্রকল্প কার্যকর করবেন বেশি দক্ষতার সঙ্গে,
এমন একটা প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে। পঞ্চায়েতকে পাশ কাটানোর ঝুঁকিও কিন্তু কম নয়, লিখছেন
শুভাশিস দে |
দক্ষিণবঙ্গের কোনও এক জেলার কোনও একটি ব্লক। গিয়েছিলাম একশো দিনের কাজ নিয়ে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করতে, কিন্তু ব্লক অফিসে এক অদ্ভুত দৃশ্য। অন্তত হাজার দেড়েক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা জড়ো হয়েছেন, সাদা জামা কাপড়, ঘোলাটে চোখ, ক্ষয়া চপ্পল। সকলের হাতে একটা করে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগ, যাকে ওঁরা বলেন ‘চিকচিকে।’ তার মধ্যে একটু মুড়ি, একটা আলুর চপ, আর একটা রসগোল্লা। দন্তহীন মুখে যে যতটা পারছেন, খাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, কোনও এক সরকারি প্রক্রিয়ার জন্য এই মানুষগুলির প্রতীক্ষা। ব্লক অফিসের দোতলায় পঞ্চায়েত সমিতির দফতরে সম্পূর্ণ অন্য চিত্র। সাদর আহ্বান এল, ‘বসে পড়ুন ভাই।’ এলাহি আয়োজন, ভাত আর পাঁঠার মাংস, চাটনি-দই-মিষ্টি। হই হই করে খাওয়া চলছে, মাঝে মাঝে দু-একজন বৃদ্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে তাকালেই তাড়া খাচ্ছেন, ‘নীচে বসুন গিয়ে, ডেকে পাঠানো হবে।’
বাধর্ক্য ভাতার প্রাপকদের ‘আইডেন্টিফাই’ করার কাজ চলছিল সে দিন। যাঁরা সে দিন মাংস-ভাত খাচ্ছিলেন, তাঁরা ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পঞ্চায়েত সমিতির প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মী। ওই ‘ক্যাম্প’-এ বৃদ্ধদের টিফিন খরচের সরকারি বরাদ্দ থেকে মাংস-ভাতের মোচ্ছব বসেছিল ব্লক অফিসে, বৃদ্ধদের জুটেছিল মুড়ি-ফুলুরি। সে দিন মনে হয়েছিল, ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ কেবল পোশাকি কথা নয়। নিজের গ্রাম থেকে অনেক দূরে এসে ওই বৃদ্ধ মানুষগুলো নিজেদের কণ্ঠ হারিয়ে ফেলেছিলেন। গ্রাম পঞ্চায়েতে হলে মাংস-ভাত আর মুড়ি-চপের দূরত্ব জোর করে কমিয়ে আনতেন তাঁরা। পঞ্চায়েতে টাকা নয়ছয় হয় না তা নয়, কিন্তু গ্রামের মানুষকে ভাগ না দিয়ে ভাগিয়ে দেওয়া সেখানে অত সহজ নয়। গ্রাম পঞ্চায়েতের বহু অনুষ্ঠানে দেখেছি, সদস্যরা সকলের সঙ্গে বসে মাছ-ভাত খাচ্ছেন। দরজা বন্ধ করে মানুষকে সেখানে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। |
পরীক্ষা না দিয়েই ফেল? |
আজ পশ্চিমবঙ্গে হাওয়া ঘুরে গিয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত কাজ করতে পারছে না, ব্লক অফিসকেই কাজ করতে হবে, নেতৃত্ব দিতে হবে, পঞ্চায়েতের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে, এমন একটা কথা শোনা যাচ্ছে। অকেজো পঞ্চায়েতের তালিকা বানানো চলছে, যাদের ক্ষমতা নিয়ে তুলে দেওয়া হবে ব্লকের হাতে। কয়েকটি জেলা পরিষদকে ইতিমধ্যেই ‘অকর্মণ্য’ ছাপ দেওয়া হয়েছে, টাকা খরচের ভার তুলে দেওয়া হয়েছে জেলা শাসকের হাতে। মোটের উপর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর, এবং নীচের স্তরের স্বশাসনের উপর একটা আস্থাহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বেশি ভরসা দেখা যাচ্ছে সরকারি কর্মীদের উপর, এবং উপরের স্তরের প্রশাসনের উপর। ভাবটা এমন যে, গ্রামে যাতে দ্রুত উন্নতি হয়, উন্নয়নের প্রকল্পগুলো কার্যকর করতে হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি গ্রাম পঞ্চায়েতগুলো রাজনীতির আখড়া হয়েই থেকে যায়, কাজ না করে, তা হলে তাদের ভরসায় থেকে গরিবের কী লাভ?
গ্রাম পঞ্চায়েত যদি উন্নয়নের টাকার সদ্ব্যবহার করতে না পেরে থাকে, তার উপর ভরসা করা চলে না ঠিকই। কিন্তু উন্নয়নের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েতে যে টাকা আসার কথা, তা কি এসেছিল? পরীক্ষায় বসতে না দিয়েই ফেল করিয়ে দিলে ছাত্রের প্রতি অন্যায় করা হয়। পঞ্চায়েতকে তার প্রাপ্য না দিয়েই তার নামে দুয়ো দেওয়া, তাকে মাঠের বাইরে বের করে দেওয়া খানিকটা তেমনই নয় কি?
রাজ্যের গ্রাম পঞ্চায়েতগুলোতে যা টাকা আসে, তার ৯৮ শতাংশ অনুদান। কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পের জন্য অনুদান ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ বেশির ভাগটাই পঞ্চায়েত উপরের নির্দেশ মতো খরচ করবে, গ্রামবাসীর প্রয়োজন বিষয়ে নিজের বোধ-অনুভব অনুসারে কাজ করার সুযোগ নেই। রাজ্য সরকারগুলোও যে তৃণমূল স্তরে টাকা দিতে খুব আগ্রহী, এমন নয়। পঞ্চায়েতকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে এ রাজ্যে তিনটি অর্থ কমিশন যা যা নির্দেশ দিয়েছিল, বাম সরকার তা পালনের চেয়ে লঙ্ঘন করেছিল বেশি। কয়েকটি তথ্য থেকেই স্পষ্ট, তিনটি অর্থ কমিশন যা বলেছিল, তার কতটা সরকার মেনেছে।
প্রথম অর্থ কমিশন রাজ্য সরকারকে রাজস্বের ১৬ শতাংশ দিতে বলেছিল পঞ্চায়েতগুলিকে, নিঃশর্ত তহবিল হিসেবে। সরকার দিয়েছিল চার শতাংশেরও কম।
রাজ্য সরকার বিনোদন কর বাবদ আদায়ের টাকা সবটাই দেবে পঞ্চায়েতকে। সরকার ৯০ শতাংশ দিতে রাজি হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত বরাদ্দ করেছিল ১৭ শতাংশ।
১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯, এই তিন বছর গ্রাম পঞ্চায়েতগুলো নিঃশর্ত তহবিলে রাজ্য সরকারের থেকে কোনও টাকাই পায়নি।
দ্বিতীয় অর্থ কমিশন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার জন্য ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে বলে। ওই টাকা দূরে থাক, অনেকগুলো বছর কোনও টাকাই বরাদ্দ হয়নি।
তৃতীয় অর্থ কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে, পরিকল্পনা খাতের ৫০ শতাংশ টাকা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে খরচ হয়েছে বলে বামফ্রন্ট সরকার দাবি করলেও, আসলে পাঁচ শতাংশ টাকা খরচ হয়েছে। বেশির ভাগ টাকাটাই খরচ হয়েছে সরকারি দফতরগুলোর মাধ্যমে, আর তার সিংহভাগ মাইনে দিতে গিয়েছে।
আবার স্থানীয় কর বসিয়ে টাকা তোলার সুযোগও পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের হাতে অতি সামান্য। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনাতেও পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে। কেরলে যেখানে নিজস্ব তহবিলের পরিমাণ মাথাপিছু ১১২ টাকা, ভারতের গড় ৩৭ টাকা, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ১৯ টাকা। এ থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, কেন্দ্রের সরকার বা রাজ্য সরকার, দু’তরফেই পঞ্চায়েতগুলিকে ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার করে রেখেছে। |
বাতিল করার আগে |
পঞ্চায়েতকে যে সব কাজের জন্যই উপর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তার নিজের ইচ্ছেয় খুব সামান্য কাজই হতে পারে, তা গ্রামের মানুষ ভালই বোঝেন। সেই জন্য দরখাস্ত- ডেপুটেশন-ঘেরাও, এগুলোর কেন্দ্রে বেশির ভাগ সময়ে থাকে বি ডি ও-র অফিস। আবার উলটোটাও ঘটে গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য বা কর্মীদের হয়রান হতে হয়, এমনকী মারও খেতে হয় রুষ্ট মানুষের হাতে এমন সমস্যার জন্য, যার প্রতিকারের সাধ্য তাদের নেই।
এক দিকে আমলারা পঞ্চায়েতকে এলেবেলে করে রাখছেন, অন্য দিকে স্থানীয় নেতারা পঞ্চায়েতের উপর ইচ্ছে মতো খবরদারি করছেন। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, একশো দিনের কাজ কোথায় হবে, এ বিষয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে এক রকম পরিকল্পনা পাশ করা হয়, কিন্তু টাকা আসার পর বার বার সংশোধনী পরিকল্পনা পাশ করতে হয়। কারণ দলের দফতর থেকে চিরকুট আসে, এখানে নয়, কাজ করতে হবে ওখানে। প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এক বা তারও বেশি বার সংশোধনী পাশ করাতে হচ্ছে পঞ্চায়েত সদস্যদের।
এগুলো খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, পঞ্চায়েত কেবল রাজনীতির আখড়া, দুর্নীতির ডিপো এই বলে পঞ্চায়েতকে বাতিল করার প্রবণতাকে খতিয়ে দেখা দরকার। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে উন্নয়নের বহু সমস্যা রয়েছে, কিন্তু সেই সমস্যা সবটাই পঞ্চায়েতের তৈরি নয়। গরিব মানুষের চাহিদা-মতো পঞ্চায়েতকে কাজ করতে দেওয়ার অনিচ্ছাও পঞ্চায়েতের ব্যর্থতার মস্ত কারণ। আর পঞ্চায়েতের বিকল্প বলে যে সব ব্যবস্থার উপর ভরসা রাখা হচ্ছে, সেগুলো কতটা স্বচ্ছ থাকবে, গরিবের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল হবে, গরিব মানুষ সেখানে নিজের দাবি কতটা জোরের সঙ্গে বলতে পারেন, সে প্রশ্নটাও বার বার করতে হবে, করা জরুরি।
না হলে গরিবকে উন্নয়নের দরজার বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখা হবে।
|
ব্রিটেনে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির গবেষক |
|
|
|
|
|