সহ্য করেছেন ফৌজিশাহির নিপীড়ন, দেশবাসীকে অহিংস গণতন্ত্র থেকে সরতে বলেননি।
সে দিক থেকে সু চি-র তুলনা শুধু মহাত্মা গাঁধী। লিখছেন
গৌতম রায় |
এই বিশ্বের ইতিহাসে মহত্তম রাজনৈতিক বন্দির নাম যদি হয় নেলসন ম্যান্ডেলা, দ্বিতীয় নামটি অবশ্যই মায়ানমারের আউং সান সু চি। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ফৌজিশাহির কাছ থেকে তাঁকে যে নিষেধের কাঁটাতারে বেদনার্ত হতে হয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। ম্যান্ডেলার মতো তাঁকে কঠোরশ্রম কারাদণ্ড সহ্য করতে হয়নি ঠিকই। কিন্তু দেশবাসীর গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চেয়ে সু চি-কে তাঁর পরিবার, অনুরাগী, দল ও সমর্থকদের থেকে যে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা ও স্বৈরাচারীর রক্তচক্ষু সহ্য করতে হয়েছে, অনেক পোড়-খাওয়া রাজনীতিককেই ভেঙে ফেলার পক্ষে তা যথেষ্ট। সু চি কিন্তু অবিচল। সশস্ত্র বিদ্রোহ বা গেরিলা প্রতিরোধের যুক্তি, প্ররোচনা ও উপাদান থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হননি। সেই বিচারে মহাত্মা গাঁধী ছাড়া কারও সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে না। তাই গাঁধীর মতোই কোনও সচেতন প্রয়াস ছাড়াই তিনি দেশবাসীর উপর প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর নৈতিক কর্তৃত্ব। মায়ানমার পার্লামেন্টের উপনির্বাচনে ৪৪টি আসনে লড়ে ৪৩টি আসন জয় করে তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সাফল্য আশু পরিণামে সীমাবদ্ধ বিজয়, যা অন্তত এখনই দেশের শাসনপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ সু চি-কে দেবে না। কিন্তু এই জয়ের প্রতীকী তাৎপর্য উপলব্ধি করে দেশবাসী উৎসবে মেতেছেন।
দেশের সাবেক রাজধানী রেঙ্গুন (এখন ইয়াঙ্গন) শহরেই ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন সু চি-র জন্ম। |
বাবা আউং সান জেনারেল ছিলেন, তিনিই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে দরকষাকষি করে দু’বছর পরে স্বাধীনতা আনেন। কিন্তু বাহিনীতে তাঁর প্রতিপক্ষ জেনারেলরা তাঁকে হত্যা করে। সু চি-র মা খিন কি ১৯৬০ সালে ভারত ও নেপালে মায়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন, শুরু হয় সু চি-র ভারতবাস। দিল্লিতে জিসাস অ্যান্ড মেরি কনভেন্ট স্কুল, লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে অক্সফোর্ডে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা। ক্রমে তিব্বতি বিদ্যার সুপণ্ডিত ডক্টর মাইকেল অ্যারিস-এর সঙ্গে প্রণয়, বিবাহ, দুই পুত্রের জন্ম। ১৯৮৮ সালে সু চি যখন মুমূর্ষু মায়ের শুশ্রূষার জন্য ফিরলেন, মায়ানমারে তখন ফৌজিশাহি জাঁকিয়ে বসেছে। ফৌজি শাসক জেনারেল নে উইন-এর পদত্যাগের সঙ্গে-সঙ্গেই গণতন্ত্রের দাবিতে দেশ উত্তাল। বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে শত-শত মানুষ নিহত। সু চি রাজধানীতে পাঁচ লক্ষ মানুষের সমাবেশে গণতন্ত্রের দাবিতে বক্তৃতা দিলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মারফত সেই দাবি আদায়ের জন্য গড়ে তুললেন এনএলডি। অচিরেই তাঁকে স্বগৃহে অন্তরিন করা হল। শুরু হল নেত্রীকে সমর্থক-সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া।
সু চি অপ্রতিরোধ্য। বিখ্যাত বক্তৃতায় বললেন‘ক্ষমতা মানুষকে তত দুর্নীতিগ্রস্ত করে না, যতটা করে ভয়, ক্ষমতা হারাবার ভয়। এই ভয় থেকেই ক্ষমতাবানরা দুর্নীতিতে লিপ্ত হয় আর ক্ষমতাশীলদের দ্বারা নিয়ত নিপীড়িত হওয়ার সন্ত্রাসই শাসিতদেরও নীতিভ্রষ্ট করে দেয়।’ ১৯৯০ সালে ফৌজি শাসকরা যখন দেশে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করল, এনএলডি ৬০ শতাংশ ভোট এবং পার্লামেন্টের ৮১ শতাংশ আসন দখল করল। ফৌজিশাহি এই জনাদেশ খারিজ করল, সু চি-ও অন্তরিন দশায় ফিরে গেলেন। এ সময় তাঁকে দেশ ছাড়ার জন্য জেনারেলরা বারবার অনুরোধ করেছেন, সু চি-র স্বামী মাইকেল অ্যারিস যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে স্ত্রীর কাছে ফিরতে চাইছেন, সে-আবেদন অগ্রাহ্য করে সু চি-কে তাঁর স্বামীর কাছে চলে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু সু চি জানতেন, এক বার দেশ ছাড়লে তাঁর প্রত্যাবর্তনের পথ বন্ধ। তাই মৃত্যুশয্যায় স্বামীর পাশে থাকার জন্যও তিনি মায়ানমার ছাড়েননি। অশ্রু চেপে রেখে নিরন্তর দেশবাসীকে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়ে গিয়েছেন। আজ যখন দলীয় সমর্থকরা তাঁকে ‘মাদার সু’, ‘আন্টি সু’ বা ‘ম্যাডাম সু’ বলে সম্বোধন করে, তখন ব্যক্তিগত জীবনে ত্যাগ স্বীকারের আখ্যানটি সেই সম্বোধনে লুকিয়ে থাকে। সন্তানদের জন্য মা যেমন নিজেকে বিসর্জন দেয়, উৎসর্গ করে, মায়ানমারবাসী মনে করে, সু চি-ও তাদের জন্য ততটাই করেছেন। তাঁদের মন থেকে সু চি-কে মুছে ফেলা অসম্ভব।
সু চি থেরবাদী বৌদ্ধ। অহিংসায় তাঁর আজীবন বিশ্বাস। উপরন্তু উপমহাদেশের রাজনীতিতে মহাত্মা গাঁধীর দৃষ্টান্ত তাঁর সামনে। তাই ম্যান্ডেলা প্রতিরোধের জন্য বর্ণবৈষম্যবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ধারণের যতটুকু অনুমোদন দিয়েছিলেন, সু চি ততটাও মঞ্জুর করতে পারেন না। তাঁর সমর্থক ও দরিদ্র সাধারণ মানুষের ওপর ফৌজি স্বৈরতন্ত্রীদের অত্যাচার যত তীব্র হয়েছে, অহিংস গণতন্ত্রের এই পূজারিণীর সঙ্কল্প তত অনমনীয় হয়েছে, বহির্বিশ্বে ফৌজি শাসকদের প্রতি ধিক্কার তত মুখর হয়েছে। প্রথমটা শাসকদের কিছু এসে যায়নি। কিন্তু ক্রমশ অর্থনীতির দেউলিয়া দশা, বর্ধমান দারিদ্র, বাণিজ্যে অবরোধ এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ, পশ্চিমী গণতন্ত্র এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রতিবেশীদের উত্তরোত্তর চাপের সামনে তারাও গণতন্ত্রের একটা আপাত ও সাময়িক চেহারা তুলে ধরতে উদ্গ্রীব হয়েছে। সেই সূত্রেই সু চি-র অন্তরিন দশার বিলোপ, তাঁকে ভোটদানের এবং ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার ফেরানো এবং এনএলডি-র ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
সমাজের সর্বস্তরের মানুষই সু চি-র সমর্থনে সমাবেশিত। ‘মাদার সু’-র মুক্তির দাবিতে গেরুয়াধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনী নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে, তাঁদের গ্রেফতার করেছে। তাতেও তাঁরা সু চি-কে ছেড়ে যাননি। সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনের ফলেও দেখা যাচ্ছে, যে-সব এলাকায় প্রধানত ফৌজের অনুগ্রহনির্ভর সরকারি কর্মচারীদের পরিবারগুলির বাস, সেখানেও সু চি ভোট পেয়েছেন প্রচুর। তিনি যে ফৌজি শাসকদের অত্যাচার সহ্য করলেও জনতাকে সশস্ত্র প্রতিরোধে উস্কানি দেননি, এই অহিংসা তাঁর পক্ষে গিয়েছে। শেষে ফৌজি শাসকরাও তাঁকে ক্ষমতার শরিক বানাতে ব্যগ্র । লক্ষ করুন, সু চি কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও অবরোধ বা বয়কটের কূটনীতি দিয়ে অত্যাচারী শাসকদের শায়েস্তা করার বিরোধিতা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ যে-সব পশ্চিমী রাষ্ট্র মায়ানমারকে ভাতে-পানিতে মেরে স্বৈরতন্ত্রকে নতজানু করতে চেয়েছে, তিনি তাদের সবিনয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এর পরিণামে দেশের সাধারণ, হৃতসর্বস্ব মানুষরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়বেন, ফৌজি অভিজাততন্ত্রের কিছু যাবে-আসবে না।
সু চি-র বয়স এখন ৬৭। তাঁর ভবিষ্যতের পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। ফৌজি শাসকদের খামখেয়াল বদলে গেলেই তাঁকে আবার স্বগৃহে অন্তরিন হতে হবে। কিন্তু মনুষ্যত্বের অপরাজেয়তার তাঁর বিশ্বাস অবিচল। তাই জঙ্গি জমানার চূড়ান্ত অবসান এবং গণতন্ত্রের অভিষেকের জন্য এখনও তিনি অনেক পথ হাঁটতে প্রস্তুত। |