শহরবাসীর একাংশের নিকট শ্রীপরেশ পাল এখন নায়কের মর্যাদা পাইতেছেন। তিনি যাহা করিয়াছেন, তাহা যে সমর্থনযোগ্য নহে, তাহা সকলেই স্বীকার করিবেন যাঁহারা তাঁহাকে আন্তরিক ভাবে সমর্থন করিতেছেন, তাঁহারাও। শ্রীপাল এক জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁহার কাজ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ফলে, তিনি যখন নিজের হাতে আইন তুলিয়া লন, তখন তাহা দ্বিগুণ নিন্দার্হ। এই কথাটিও দুর্বোধ্য নহে। কিন্তু যখন সব বুঝিয়াও মানুষ বিধায়কের এই অসাংবিধানিক, অন্যায় আচরণে আন্তরিক করতালি দেন, তখন এক বার ফিরিয়া ভাবাই বিধেয়। মানুষের এই উচ্ছ্বাস এক অতি দুঃখজনক বাস্তবের প্রমাণ এই রাজ্যে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা নাই। তাঁহারা অন্তরে জানেন, আইন, প্রশাসন তাঁহাদের রক্ষার্থে কুটোটি নাড়িবে না। বস্তুত, কলিকাতার যে রাস্তায় শ্রীপাল বিশৃঙ্খল অটোচালকদের ‘শাসন’ করিয়াছিলেন, সেইখানে পুলিশ বিলক্ষণ উপস্থিত ছিল। অটোচালকদের তাণ্ডবে মানুষ সন্ত্রস্ত, বিপর্যস্ত হইতেছে দেখিয়াও উপস্থিত পুলিশকর্মীরা নড়েন নাই। রাজ্যের মানুষ এই বাস্তবেই অভ্যস্ত। বিশৃঙ্খলার শিকার হইতে হইতে তাঁহাদের মনে ক্ষোভের পাহাড় জমিয়াছে। সেই পাহাড়ের ছায়ায় ন্যায়-অন্যায় বোধ ঢাকিয়া যাইবে, অন্যায় আচরণ করিয়াও শ্রীপাল পরিত্রাতার আসনে উন্নীত হইবেন, তাহাতে আশ্চর্য কী?
গত কয়েক দিনে অটোচালকদের বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছাইয়াছে। কিন্তু, তারসপ্তকে না হউক, উদারা-মুদারায় বিশৃঙ্খলার সুর এই রাজ্যে সর্ব ক্ষণই বাজিতেছে। গত দশ মাসে রাজ্যে শৃঙ্খলার দেখা পাওয়া ভার হইয়াছে। কেহ বলিতেই পারেন, পরিবর্তন আসিয়া শৃঙ্খলাকে লইয়া গিয়াছে। পূর্বের ৩৪ বৎসর যে দল এই রাজ্য শাসন করিয়াছিল, তাহার অভিজ্ঞান ছিল শৃঙ্খল। দলতন্ত্রের শৃঙ্খল। সেই শৃঙ্খল-বদ্ধ দলের শাসনে পশ্চিমবঙ্গের যে ক্ষতি হইয়াছে, তাহা অধুনা বহুচর্চিত। কিন্তু, শৃঙ্খলের হাত ধরিয়া রাজ্যে এক রকম শৃঙ্খলাও আসিয়াছিল। প্রশাসনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া যাহা প্রাণে চাহে, তাহাই করা সম্ভব এই কথাটি পশ্চিমবঙ্গে গত দশ মাসে যে রকম ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহা পূর্বের ৩৪ বৎসরেও হয় নাই। পশ্চিমবঙ্গ, এবং রাজধানী কলিকাতা, ক্রমে বিশৃঙ্খলার মুক্তাঞ্চলে পরিণত হইতেছে। শৃঙ্খল-বদ্ধ দলের বিদায়ে যে মুক্তির আশ্বাস ছিল, শৃঙ্খলার বিদায়ে তাহা অপস্রিয়মাণ।
রাজ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায় যে প্রশাসন এবং শাসক জোটের উপর বর্তায়, তাহা সম্ভবত নেতারা জানেন। তাঁহারা সেই দায়িত্বটি পালন করিতে পারেন নাই। কেন, তাহার একটি জবাব শাসকদের নিকট রহিয়াছে। তাঁহারা বারে বারেই জানাইয়াছেন, সকলই ষড়যন্ত্র, তাঁহাদের সরকারকে হেনস্থা করিবার প্রয়াস। অটোচালকদের বর্তমান জঙ্গিপনার পরেও শাসকপক্ষ বিরোধীদের দায়ী করিয়াছেন। কিন্তু, যে কারণেই বিশৃঙ্খলা ঘটুক, তাহা নিয়ন্ত্রণ করিতে যে সরকার ব্যর্থ হয়, তাহার কি শাসনের অধিকার থাকা উচিত? কেন প্রশাসন শৃঙ্খলা বজায় রাখিতে এমন সার্বিক ভাবে ব্যর্থ হইতেছে, তাহার যথার্থ উত্তর সাধারণ্যের নিকট রহিয়াছে নেতাদের সেই সদিচ্ছা নাই। থাকিলে, প্রশাসনের কাজে নাক গলাইবার কু-অভ্যাসটি তাঁহারা পূর্বেই ত্যাগ করিতেন। যিনি এই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, তিনি পুলিশের তদন্ত শেষ হইবার পূর্বেই বলিয়া দেন, সমস্ত অভিযোগই সাজানো। প্রশাসনের যে কোনও ব্যর্থতায় ষড়যন্ত্র খোঁজেন। মুখ্যমন্ত্রী যে পথে হাঁটেন, সেই পথ ত্যাগ করিবার সাহস বা ইচ্ছা, কোনওটাই তাঁহার পারিষদদের নাই। ফলে, ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের বামপন্থী উত্তরাধিকারটিই এই রাজ্যের বর্তমান শাসকদের সার। তাহাতে রাজনীতির সাধন হইতে পারে, প্রশাসনের দায়িত্ব পালন হয় না। সম্পূর্ণ অন্যায় আচরণের পরেও পরেশ পালদের ‘নায়ক’-রূপে বরণ করিয়া লওয়াই কি তবে এই রাজ্যের ভবিতব্য? |