অর্থনীতির উল্টোরথের ধাক্কায় সঙ্কটে অটো
দুধের দাম বাড়লে রসগোল্লার দাম কি একই রাখা সম্ভব?
অর্থনীতির কথায়, সাধারণ ভাবে তা কখনওই সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে দাম এক রাখতে গেলে রসগোল্লা বিক্রেতাকে হয় তাঁর লাভের একটি অংশ ছেড়ে দিতে হবে অথবা কোনও ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হবে।
অর্থাৎ দুধের দাম বাড়লে হয় তাঁকে রসগোল্লার দাম বাড়াতে হবে, না হলে আগের চেয়ে ছোট মাপের রসগোল্লা বিক্রি করে ব্যবসা চালাতে হবে।
এই সহজ তত্ত্বের উল্টো পথে হাঁটলে প্রতিপদে যে হোঁচট খেতে হবে, তা স্বতঃসিদ্ধ। অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য: সম্প্রতি শহরে অটো নিয়ে যে গোলমাল, তার মূলেও রয়েছে জনমোহিনী রাজনীতির কারণে অর্থনীতিকে অস্বীকার করার প্রবণতা।
অটো নিয়ে শহর জুড়ে গোলমালের সঙ্গে কেন জড়িয়ে পড়ল অর্থনীতি?
কারণ, গত এক বছরে অটোর জ্বালানি গ্যাসের দাম ৪১ শতাংশ বেড়েছে। এই জ্বালানির দাম নির্ধারণে এখন কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তার দাম ঠিক করে থাকে। জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে অটোর ভাড়াও বৃদ্ধি পাওয়া উচিত বলে প্রশাসনের একাংশও মনে করছেন। না হলে অটোচালকের রোজগারে টান পড়বে। অর্থাৎ আগের চেয়ে কম টাকায় তাঁকে সংসার চালাতে হবে।
রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের জমায়েতে এক অটোচালক। ছবি: প্রদীপ আদক
করুণাময়ী-ফুলবাগান রুটে দীর্ঘদিন অটো চালাচ্ছেন সোমনাথ বর্মন। তাঁর বক্তব্য, “আগে পেট্রোলে প্রতি লিটারে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত অটো চলত। এখন গ্যাসে চলে ২০ কিলোমিটারের মতো। গ্যাসের দাম লিটার প্রতি ৫৩ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের আয় ক্রমশ কমছে।” নতুন অটোর রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অনেক বেশি বলে জানান সোমনাথবাবু। রাজাবাজারের বাসিন্দা ৪১ বছরের আনসার আহমেদ প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘণ্টা করে অটো চালান। তিনি বলেন, “দিনের শেষে নিজের বলতে থাকছে বড়জোর ২০০ টাকা। কী করে সংসার চালাচ্ছি, তা আমরাই জানি!”
কিন্তু জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ার সঙ্গে অটোচালকদের আয় কমে যাওয়ার এই সরল যুক্তিটাই মানছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। রাজ্যের সব অটো ইউনিয়নই এখন কার্যত তাঁদের দখলে। দলীয় নীতি মেনে তাঁরা অটোর ভাড়া বাড়তে দিতে চাইছেন না। দু’একটি ক্ষেত্রে ভাড়া যেটুকু বেড়েছে, তাতে লাগাম পরানোর জন্য রাজ্য সরকার বাস বা ট্যাক্সির মতো অটোর ভাড়াও নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষপাতী। অর্থনীতির শিক্ষকদের কথায়, এখানেই বিপত্তি দেখা দিয়েছে। জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ানো-কমানোর উপরে যখন
রাজ্য সরকার (বা শাসক দলের) কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে অটোর ভাড়া না বাড়তে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, অটোচালকরা (বহু ক্ষেত্রে তারাই মালিক) নিম্ন আয়ের মানুষ। জ্বালানি গ্যাসের দাম
বাড়লে তাঁদের সামান্য রোজগারে যে টান পড়ে, তা তাঁরা সামলাতে পারেন না।
তা হলে কি জ্বালানি গ্যাসের দাম ৪১ শতাংশ বাড়লে অটোর ভাড়াও একই গুণিতকে বাড়িয়ে দিলে সমস্যা মিটবে? অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, অটোই শহরের গণ-পরিবহণের একমাত্র মাধ্যম নয়। জ্বালানি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শুধু অটোর ভাড়া লাফিয়ে বাড়লে বাস, ট্রাম বা মেট্রো রেলের সঙ্গে তার কোনও সমতা থাকবে না। কারণ, সরকার সেখানে ভর্তুকি দিয়ে চলেছে। (ব্যতিক্রম অবশ্য বেসরকারি বাস ও ট্যাক্সি। কিন্তু ভাড়া না বাড়ায় এর মধ্যেই বেশ কিছু বেসরকারি বাস বসে গিয়েছে বলে সরকারি সূত্রেই বলা হয়েছে) অটোকে তাই প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে ওই সব কম ভাড়ার গণ-পরিবহণের সঙ্গে।
যেমন, এখন রুবি হাসপাতাল থেকে গড়িয়াহাটের মোড় পর্যন্ত বাসে যেতে চার টাকা ভাড়া লাগে। একই পথে অটোয় যেতে গেলে লাগে সাত টাকা। এই ভাড়া আরও বেড়ে দশ টাকা (৪১ শতাংশ বাড়িয়ে) বা তার কাছাকাছি হলে যাত্রীদের একাংশ অটো ছেড়ে বাসে যাওয়াই পছন্দ করবেন। এতে বিপদে পড়বেন অটোচালকরাই। অর্থাৎ গণ-পরিবহণের অন্য মাধ্যমগুলির ভাড়া না বেড়ে শুধু অটোর ভাড়া বাড়লেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাবে না।
নিজেদের অভিজ্ঞতা নিরিখে এই সহজ সত্যটা বুঝে ফেলেছেন অটোচালকেরা। তাই জ্বালানি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শুধু ভাড়া বাড়ানোর দাবির মধ্যেই নিজেদের আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখছেন না তাঁরা। তাঁদের দাবি, অটোতে চার জনের বেশি যাত্রী তুলতে দিতে হবে। অটোচালক অজয় দাসের কথায়, “পাঁচ জন যাত্রী নিলে সারা দিনে ২৫০ টাকার মতো রোজগার হয়। এক জন করে যাত্রী কমে গেলে রোজগার দিনে প্রায় ১০০ টাকার মতো কমে যায়। সারা দিন অটো চালিয়ে যদি ১৫০-২০০ টাকা রোজগার হয়, তা হলে বাড়িভাড়া কী করে দেব, সংসার-ই বা কী করে চলবে, ছেলেমেয়েদের স্কুলেই বা কী করে পড়াব? চার জনের বেশি যাত্রী তুলতে না দিলে অটো চালানো ছাড়তে হবে।”
অর্থাৎ ভাড়া একটি সীমার মধ্যে বেঁধে রেখে অতিরিক্ত যাত্রী তুলে আয় বাড়াতে চাইছেন অটোচালকেরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে। পুলিশের বক্তব্য, এই কারণেই অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া নিয়মবিরুদ্ধ। বাজারে নতুন যে অটো আসছে তাতে চালকের পাশে বসার সিটই তুলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অটোচালকদের পাল্টা বক্তব্য, “তা হলে বাস-ট্রামে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হবে কেন? ওরা অতিরিক্ত যাত্রী তুললে আমরাও তুলব।”
এর মধ্যে অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এত দিন কীসের ভিত্তিতে ভাড়া ঠিক করেছে অটো ইউনিয়নগুলি? পরিবহণ দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, বাস, মিনিবাস বা ট্যাক্সির ক্ষেত্রে ভাড়া ঠিক হয় কিলোমিটারের হিসাবে। অটোর ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয় না। একই দূরত্বের জন্য শহরের বিভিন্ন প্রান্তে এক এক রকমের ভাড়া। অটোচালকদের লাভের অঙ্কও তাই এক এক জায়গায় এক এক রকম।
এ ব্যাপারে কী বলছেন ইউনিয়নের নেতারা? এত দিন যাঁরা অটো ইউনিয়নগুলি নিয়ন্ত্রণ করতেন, সেই সিটু-র নেতারা স্বীকার করছেন, তাঁদের আমলে অটোর ভাড়া ঠিক করার ক্ষেত্রে কোনও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নেওয়া হয়নি। সিটু-র অটো ইউনিয়নের নেতা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “রুটগুলি নিজেদের মতো করে ভাড়া ঠিক করত। এখন আমরাও চাইছি, কিলোমিটারের ভিত্তিতে সরকার ভাড়া ঠিক করে দিক। অটোর রুট কী হবে, কত জন যাত্রী তোলা হবে তা-ও ঠিক করুক সরকার।” পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এ দিন বলেন, “সরকার কিলোমিটারের ভিত্তিতে ভাড়া ঠিক করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ-কমিটি তৈরি করবে।” আগামী ৮ এপ্রিল তিনি সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসছেন।
অটোচালকেরা অবশ্য এ নিয়ে বিশেষ আশাবাদী নন। করুণাময়ী-ফুলবাগান রুটের অটোচালক বাবলু বর্ধনের কথায়, “কী হবে আলোচনায় বসে? আমাদের পাঁচ জন যাত্রী নিতে দেওয়া হবে? নাকি ঘোষিত নীতি ছেড়ে তৃণমূল নেতারা অটোর ভাড়া বাড়াতে দেবেন?” জনমোহিনী রাজনীতি যে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিকে হারিয়ে দেবে কি না, সে ব্যাপারে তাঁদের সংশয় কাটছে না।

সব ঠিক করে দেবে সরকার, বললেন মদন
কলকাতা ও শহরতলির অটো চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। বুধবার মহাকরণে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পরে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “যাত্রীর সংখ্যা-সহ সব ঠিক করে দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। বেআইনি কিছুই হবে না। অটোচালকদের জন্য অবিলম্বে নির্দিষ্ট পোশাক এবং তাতে চালকের নাম, ঠিকানা ও লাইসেন্স নম্বর লিখে রাখার ব্যবস্থা করার কথাও ভাবা হচ্ছে।” এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষজ্ঞ কমিটিও তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী। এ দিন দুপুরে মহাকরণে পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন সিটু, ইনটাক, এআইটিইউসি-র প্রতিনিধিরা। বৈঠকে শহরে বিভিন্ন রুটের অটোর ভাড়া এবং যাত্রী-সংখ্যা সরকারকেই নির্দিষ্ট করে দেওয়ার আর্জি জানান তাঁরা। বৈঠকের পর প্রেস কর্নারে এসে তাঁরা পরেশ পালের গ্রেফতারের দাবি জানান। মঙ্গলবারের বিক্ষোভের সময় পরেশবাবু কাঁকুড়গাছি মোড়ে অটোচালকদের মারধর করেছেন বলে তাঁদের অভিযোগ। একই সঙ্গে, মঙ্গলবার যানবাহন ভাঙচুর ও চাণ্ডব চালানোর দায়ে যে ২৮ জন অটোচালককে পুলিশ গ্রেফতার করে , তাদের মুক্তির দাবিও জানান। সিটু নেতা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “আমরা মানছি, যাদের পুলিশ ধরেছে, তারা ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার তীব্র প্রতিবাদ করেছি। বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে তারা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কিন্তু তাদের জেলে পাঠানো অন্যায় হবে।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.