প্রথমে বিদ্যুতের মাসুল। তার পর শিল্পের জন্য জমির ঊর্ধ্বসীমা। ‘বাস্তব’ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘অনড়’ মনোভাব থেকে পিছিয়ে আসতে শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জনগণের উপর ‘আর্থিক বোঝা’ চাপাবেন না ঘোষণা করে এই সে দিন পর্যন্তও বিদ্যুতের মাসুল বাড়াতে চাইছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে হয়েছে তাঁকে। কয়লার দামবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ দফতরের চাপে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ এক লাফে অনেকটাই বাড়িয়েছে তাঁর সরকার। শিল্পের জন্য জমির ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া নিয়েও বেঁকে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ নিয়ে শিল্পমহলের একাংশের ক্রমাগত দাবির জবাবে ‘কটাক্ষ’ করতেও ছাড়েননি মমতা। সম্প্রতি বাছাই কিছু চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও সাফ বলেছিলেন, “আমি ল্যান্ড-সিলিং তুলব না! সে যে যতই বলুক!” মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রকাশ্যে এ কথা বলছেন, তখন তাঁরই সরকার কিন্তু জমির ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। যার ফল, সোমবার বিধানসভায় নতুন সরকারের ভূমিসংস্কার বিলের সংশোধনী। সোমবার যে সংশোধনী গৃহীত হল, তাতে এটা স্পষ্ট যে, ‘সরকার নির্দেশিত’ শিল্পের জন্য জমি নিলে ঊর্ধ্বসীমা আইনে তা আটকাবে না। যাকে প্রশাসনিক মহল ‘শুরুর ইতিবাচক পদক্ষেপ’ বলেই ব্যাখ্যা করছে।
ভূমিসংস্কার আইনে ঊর্ধ্বসীমার যে ধারা (১৪ এম) রয়েছে, তা অবশ্য সরাসরি ‘বাতিল’ করা হয়নি। তবে প্রশাসনিক মহলের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে প্রকাশ্যে তাঁর ‘অনড়’ থাকার কথা বলেছিলেন, তার পরে এই পদক্ষেপ যথেষ্ট ‘ইতিবাচক’। যার মধ্যে ভবিষ্যতে আরও ‘নমনীয়’ হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। বস্তুত রাজ্যের শিল্পমহলও মনে করে, মমতার সরকার ভূমি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করায় বিনিয়োগকারীদের কিছুটা সুবিধা হবে ঠিকই। কিন্তু রাজ্যে পুরোমাত্রায় শিল্পের প্রসার ঘটাতে হলে আইনি বাধা পুরোপুরি দূর করতে হবে।
মঙ্গলবার রাজ্যের ভূমি ও ভূমিসংস্কার দফতরের এক কর্তা জানান, আইনের ১৪ এম ধারায় সেচসেবিত এলাকায় ১৭.৩০ এবং অ-সেচসেবিত এলাকায় ২৪.২২ একর জমিকে ‘ঊর্ধ্বসীমা’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৪ ওয়াই ধারায় সেই ঊর্ধ্বসীমায় ‘ছাড়’ দিয়ে বেশি জমি রাখার অনুমতি দেয় সরকার। বিধানসভায় আনা সংশোধনীতে ১৪ ওয়াই ধারার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ, আগে যে সাতটি শিল্পক্ষেত্রকে ১৪ ওয়াই ধারায় ‘ছাড়’ দেওয়া হত, সংশোধনের পরে সেই তালিকায় আরও কয়েকটি শিল্পক্ষেত্রকে ঢোকানো হয়েছে। সামগ্রিক ভাবে জমির ঊধ্বর্র্সীমা আইন যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে।
দেশের প্রায় সমস্ত রাজ্যে ‘আরবান ল্যান্ড-সিলিং আইন’ বাতিল হয়ে গেলেও এ রাজ্যে এখনও তা রয়েছে। এমনকী, অন্যান্য রাজ্যের ভূমিসংস্কার আইনে ঊর্ধ্বসীমা হিসাবে যে পরিমাণ জমির কথা বলা আছে, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে তা কয়েকগুণ বেশি। শিল্প দফতরের অফিসারদের মতে, অন্য রাজ্যগুলিতে মূলত গ্রামাঞ্চলের কৃষিজমি ব্যবহারের ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বসীমা আইন বলবৎ রয়েছে। শিল্পের কথা মাথায় রেখে শহরাঞ্চলের জমির ঊধ্বর্র্সীমা আইন ইতিমধ্যেই তুলে দেওয়া হয়েছে।
শিল্পমহলের অভিমত, সোমবার বিধানসভায় যে বিল পাশ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিসংস্কার আইনের ১৪ ওয়াই ধারা সংশোধন করে তার পরিধি বৃদ্ধি করা। এর অর্থ, আইনের যে ধারায় (১৪ এম) জমির ঊর্ধ্বসীমা (২৪.২২ একর) বেঁধে দেওয়া হয়েছে, ১৪ ওয়াই ধারা সংশোধনের ফলে তার থেকে ‘ছাড়’ পাবে প্রায় সব শিল্পক্ষেত্রই। শুধু তাই নয়, উর্ধ্বসীমার বেশি জমি সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারী অন্য কোনও বিনিয়োগকারীকে ‘লিজ’-ও দিতে পারবেন।
শিল্প দফতরের এক মুখপাত্রের ব্যাখ্যা, ছাড়ের তালিকায় যত ধরনের শিল্পক্ষেত্রকে ঢোকানো হয়েছে, তার বাইরে কার্যত আর কোনও শিল্প হয় না! আক্ষরিক অর্থেই ‘আলপিন টু এলিফ্যান্ট’। ফলে এ বার শিল্পের জন্য ঊর্ধ্বসীমার বেশি জমির প্রয়োজন হলে তার অনুমোদন পেতে বছর গড়িয়ে যাবে না। অকারণ সরকারি হেনস্থার হাত থেকেও বাঁচবেন বিনিয়োগকারী। আগে ঊর্ধ্বসীমার বেশি জমি শুধু নিজের কাছে রাখা যেত। এখন সেই জমি সরকারের ঘোষিত তালিকা মেনে শিল্পের জন্য অন্যকে লিজ-ও দেওয়া যাবে। উপরন্তু, ১৪ ওয়াই ধারায় ছাড় পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে শিল্পসংস্থার যে দীর্ঘ তালিকা জমা পড়ে, তারও অবসান হবে। কারণ, আইন মেনে এগোলে ছাড়ের অনুমতি পেতে বেশি সময় লাগার কথা নয়।
শিল্পমহলের আরও ব্যাখ্যা, আধুনিক নিয়মে সার, রাসায়নিক শিল্পতালুক, গাড়ি-সহ বেশ কিছু শিল্প রয়েছে, যেখানে মূল কারখানা ও তার অনুসারী শিল্পকে এক জায়গায় রাখতে হয় (যেমন সিঙ্গুরে টাটা-ন্যানোর কারখানার ক্ষেত্রেও ছিল)। এ সব ক্ষেত্রে মূল বিনিয়োগকারীই অনুসারী শিল্পের নির্মাতাকে তাঁর হাতে থাকা জমি লিজ দিতে পারবেন। এ জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। যেমনটা হয়েছিল সিঙ্গুরে। আবার, এখনকার ধারণা মতো একই গোত্রের শিল্পকে এক ছাতার তলায় রাখতে জল-বিদ্যুৎ-রাস্তার মতো পরিকাঠামোও তৈরি করে দেবে সরকার। যার পোশাকি নাম শিল্পপার্ক, হাব বা এস্টেট। এ রাজ্যে এমন ১৭টি পার্ক তৈরি করা হবে বলে ঘোষণাও করেছে সরকার। বিধি সংশোধনের ফলে এখন জমির মূল প্রাপক শিল্পপার্কের পরিকাঠামো তৈরি করে বিনিয়োগকারীকে তা লিজ দিতে পারবেন।
আইনের ৪ নম্বর ধারা সংশোধনের ফলেও বিনিয়োগকারীদের সুবিধা হবে বলে মনে করছে শিল্প দফতর। এই সংশোধনের ফলে কোনও জমির মালিক (রায়ত) সরকারের ঘোষিত কয়েকটি নির্দিষ্ট শিল্পক্ষেত্রের জন্য তার জমি ‘লিজ’ দিতে পারবেন। শিল্প দফতরের এক মুখপাত্রের কথায়, “জমি কিনে শিল্প করতে গেলে বিনিয়োগকারীকে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে জমির দাম নিয়ে বিরোধ-সহ অনেক কিছু। অধিগ্রহণের ক্ষেত্রেও প্রায় একই সমস্যা (যদিও তা করে সরকার)। কিন্তু লিজ-এ জমি পেলে এ সব ঝামেলা থাকা উচিত নয়। ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দেওয়ার প্রশ্নে আইনত বিনিয়োগকারীর দায় অনেক কম থাকে।” |