ইরাকিদের প্রেরণা জিকো, ইস্টবেঙ্গলের আল-জাওরা |
রূপায়ণ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
ইরাক দেশটার কথা বললেই এক এক জনের এক একটা শব্দ মনে পড়ে।
সাদ্দাম হোসেন। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ। মেসোপটেমিয়া। বাগদাদ। বসরাই গোলাপ। কারবালা। টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদী। তেল। জর্জ বুশ।
রাজনীতির ছাত্রের কাছে ইরাক মানে এক রকম। ইতিহাস, ভুগোল বা সমাজতত্বের ছাত্রদের কাছে অন্য শব্দ।
ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের কাছে ‘ইরাক’ মানে অন্য। বললেই তাঁরা বলে উঠবেন, ‘ইরাক মানে তো আল জাওরা ক্লাব!”
উনিশ বছর আগের অক্টোবরে যুবভারতীতে শক্তিশালী আল জাওরাকে ৬-২ হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। পঁচাশি সাল থেকে টানা লাল হলুদের ম্যানেজার স্বপন বল। এ বারই ১৫০ টুর্নামেন্টে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন হল। যুবভারতীর বিস্তৃত লাউঞ্জে হাঁটতে হাঁটতে স্বপন অকপট “আল জাওরা ম্যাচই সাম্প্রতিক কালে বিদেশিদের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের সেরা জয়। তারপরে বেক তেরো সাসানা, আল উইদাত ম্যাচ থাকবে।”
বুধবার, এত দিন পরে আবার লালহলুদের সামনে একটা ইরাকি দল এএফসি কাপে আরবিল এস সি। তাদের সিরিয়ান কোচ নিজার মাহরুসকে ওই ২-৬ হারের কথা বলা হলে, পাশে বসা ইস্টবেঙ্গল কোচ ট্রেভর মর্গ্যান মজা করলেন, “ও সব ওদের মনে করিয়ে দেবেন না।” |
আল জাওরা-র বিরুদ্ধে ঠিক কোন জায়গায় বিদেশিহীন ইস্টবেঙ্গল টেক্কা দিয়েছিল? ওই ম্যাচটার তিন নায়ক এবং কোচের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কার্লটন চ্যাপম্যান তিনটি গোল করেছিলেন, তিনটি করিয়েছিলেন। গ্যাংটক থেকে চ্যাপম্যান ফোনে স্মৃতিকাতর, “গতিতেই হারিয়ে দিই ওদের। আমাদের তরুণরা সবাই দারুণ দৌড়েছিল।” শিশির ঘোষ ও কুমারেশ ভাওয়ালের একটা করে গোল ছিল সে দিন। শিশির বলছিলেন, “সবাই সবাইকে ছাপিয়ে যেতে চেয়েছিল।” কুমারেশের ব্যাখ্যা, “বিদেশিহীন দলে জাতীয়তা বোধ কাজ করেছিল।” এবং কোচ শ্যামল ঘোষ: “ওরা আমাদের ছেলেদের উচ্চতা দেখে হাসাহাসি করেছিল। কোনও নাম্বার দেয়নি। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগেছিল। তার পরে বৃষ্টির মাঠে সমস্যায় পড়ে গেছিল।”
আল জাওরার রোমাঞ্চক স্মৃতি কি টোলগে, পেন, ওপারাদের কেউ নতুন করে মনে করিয়ে দেবে?
আরবিলের সিরিয়ান কোচ নিজার মাহরুস ছিয়াশির তিরুবনন্তপুরম নেহরু কাপে খেলে গিয়েছেন। আল জাওরার মতো ভারতীয় প্রতিপক্ষকে হালকা ভাবে নেবেন না। তাঁর কথায়, “প্রথম দুটো ম্যাচ ড্র করে চাপে রয়েছি। আমাদের জিততেই হবে।”
ইস্টবেঙ্গলকে তাতাতে যদি আল জাওরা থাকে, আরবিলকে তাতানোর জন্য থাকছেন জিকো। হ্যাঁ, ব্রাজিলিয়ান জিকোই। ভাই এডুকে সহকারী করে জিকো এখন বাগদাদে। ইরাক জাতীয় দলের কোচ। ফুটবলাররা তখনও প্র্যাক্টিস করতে নামেননি, ড্রেসিংরুমে বসে ইরাকিদের মিডিয়া ম্যানেজার বলছিলেন, “জিকো এখন নতুন প্লেয়ার খুঁজছেন জাতীয় দলের জন্য। এই টিমের তিন জন জাতীয় দলে খেলেছে। আরও কয়েক জন সম্প্রতি খেলে আবার বাদ পড়েছে। সবাই চাইবে এ এফ সি কাপে ভাল খেলে জিকোর নজর কাড়তে।”
ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের রিপোর্ট, অতএব যাচ্ছে জিকোর কাছে।
আরবিল আদতে দেশের উত্তরে ইরাকি কুর্দিস্তানের ক্লাব। ইরান-ইরাক যুদ্ধের পরে, তাদের উত্থান দারুণ ভাবে। তারাই প্রথম ইরাকি ক্লাব, যারা বিদেশি ফুটবলারকে সই করায়। কলকাতায় তারা এনেছে সিরিয়ার দুই ফুটবলার, উগান্ডা ও নাইজিরিয়ার এক জন। প্র্যাক্টিস দেখে মনে হল না, সবাইকে ব্যবহার করবেন সিরিয়ান কোচ। মর্গ্যান নিজেও দ্বিধায়, এডমিলসনকে ব্যবহার করা নিয়ে। মেহতাব হোসেন ফিরে এলেও তাঁকে বেঞ্চে রাখা হচ্ছে। কিন্তু ৪-৩-২-১ ছকে টোলগে-রবিনের সামনে কে? বলজিৎ সাহনি, না, এডমিলসন? মর্গ্যান একটু হেঁয়ালিই রাখলেন।
ইরাকিরা কলকাতায় পা রেখে বারবার বোঝাচ্ছেন, সব ঠিকঠাক ও দেশে। আর কোনও সমস্যা নেই। মর্গ্যান বা টোলগের ও দেশে গেলে সমস্যা হত না। জর্ডনের ম্যাচ কমিশনার কইয়ে বলিয়ে লোক। এএফসির বয়স্কতম ম্যাচ কমিশনার বলে পরিচয় দেন নিজের। যুবভারতীতে মোহনবাগানের একটা ম্যাচ করাতে এসে দেখেছিলেন, মাঠে সাপ বেরিয়েছে। এ বারও মাঠে প্রথম এসে মজা করেই পায়ের কাছে দেখছিলেন, আবার সাপ কি না। ইরাক, ইরান ঘোরার সুবাদে ভদ্রলোক বলছিলেন, “আরবিল জায়গাটা পর্যটকদের জন্য। এমনিতে শান্ত। কোনও ছাপ পড়েনি যুদ্ধের। তাই ফুটবলটা উন্নতি করেছে।”
ইরাক ফুটবলে সত্তর-আশির দশক সোনার সময়। বিশ্বকাপ খেলা, তিনটি অলিম্পিকে খেলা, এশিয়ান কাপ জয়সব ওই সময়ই। সাদ্দাম হোসেনের ছেলে উদয় হোসেনের আমলে ইরাকি ফুটবল অন্ধকার যুগ। নব্বই দশকে এশিয়াড থেকে শুরু করে সব টুর্নামেন্টে নিষিদ্ধ। ১৩৯ এ নেমে যাওয়া। সাদ্দাম-পতনের পরে নানা বিদেশি কোচ এনে, ইরাকি ফুটবলে ফের সূর্যোদয়। অলিম্পিকে চার নম্বর। এশিয়ান গেমসে রুপো। এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে উঠে এসেছে ৭৬ এ।
মর্গ্যান এই সব দেখেশুনেই সতকর্। রিয়াল মাদ্রিদ বনাম বার্সেলোনা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের ভবিষ্যদ্বাণী করতে করতে বেরোচ্ছিলেন টোলগেকে সঙ্গে নিয়ে। বললেন, “আমাদের রক্ষণকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রথম ম্যাচে বাজে রেফারিংয়ের শিকার হয়েছিলাম। পরের ম্যাচে নিজেরাই ভুল করেছি। এটা যাতে না হয়, দেখতে হবে।” আই লিগে ডেম্পোর ড্র তাঁর মুখে হাসি ও আত্নবিশ্বাস ফিরিয়েছে। টোলগেরও। তাঁর কথা শুনলে সমর্থকরা ভরসা পাবেন, “আমরা এখন ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছি।”
আল জাওরা ছিল সাদ্দামের ইরাকের দলঅতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। আরবিল সাদ্দামহীন ইরাকেরশুধু আত্মবিশ্বাসী।
টোলগেরা এটাই মাথায় রাখছেন।
|
বুধবার
এ এফ সি কাপ: ইস্টবেঙ্গল: আরবিল, ইরাক (যুবভারতী, ৩-১৫)।
আই লিগে: চার্চিল ব্রাদার্স:চিরাগ কেরল (মারগাও), মুম্বই এফসি : শিলং লাজং (পুণে)। |