বিতর্ক...
বিতর্ক: ইরানের পরমাণু প্রকল্পে বাধা দেওয়া অন্যায়
পক্ষে
নিকৃষ্ট কূটনীতির কৌশল
ইরানের পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে অন্য পরমাণু শক্তিধর দেশগুলি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চায় কেন, সেটা প্রথমে বোঝা দরকার। আসলে, এক বার এই প্রকল্প কার্যকর করতে পারলে ইরান পরমাণু বিশ্বে আর ব্রাত্য থাকবে না। কিছুটা হলেও কমে আসবে প্রতিদ্বন্দ্বী পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির একাধিপত্য। তাই পরমাণু পরিবারে ইরানের প্রবেশের অর্থই হল বর্তমান ক্ষমতাধরদের একাধিপত্যে ভাগ বসানো।
পরমাণু প্রকল্প কিংবা পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার দৃষ্টান্ত আমরা আগেও দেখেছি। মনে করা যেতে পারে, ভারতের প্রথম সফল পরমাণু পরীক্ষার ঘটনা। সালটি ছিল ১৯৭৪। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর নেতৃত্বে পোখরানে এই পরীক্ষা ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে জনমত গঠন করে এন এস জি ভারতের উপর পরমাণু নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেই নিষেধাজ্ঞা সরতে সময় লাগে চৌত্রিশটা বছর। ২০০৮-এ এন এস জি-র সবুজ সংকেতের ভিত্তিতে ভারত পরমাণু ক্লাবের নবতম সদস্যপদ অর্জন করে।
একই ভাবে ইরানের ক্ষেত্রেও পরমাণু প্রকল্পে বাধা দেওয়ার আগেই পরমাণু শক্তিধরদের ভাবা উচিত কোনও দেশের পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার করার পথ সুগম হওয়ার মানে এই নয় যে, উক্ত দেশের এতে শুধু সামরিক শক্তির বৃদ্ধি ঘটবে। দেশের বিভিন্ন অ-সামরিক প্রয়োজনেও পরমাণু প্রযুক্তি দরকার হতে পারে। যেমন, তথ্য-প্রযুক্তি, শিল্প, মহাকাশ গবেষণা, এ ছাড়াও বায়োটেকনোলজি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তির জরুরি প্রয়োজন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের পরমাণু প্রকল্পের প্রতি বিরূপ মনোভাব শানিয়ে সে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত করা নিকৃষ্ট কূটনৈতিক কৌশল ছাড়া আর কী।
ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে অনেক দিন ধরেই। ১৯৫০-এ আমেরিকার সঙ্গে ইরানের শক্তিচুক্তির একটা অংশ ‘নিউক্লিয়ার চুক্তি’ রূপে গৃহীত হয়, যা ১৯৭৯ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। পরবর্তী কালে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই ক্রিয়াকলাপ স্তিমিত হয়ে এলেও ২০১১-র সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার সহযোগিতায় বসার রিঅ্যাক্টর-এর কর্মসূচি অনুসারে ৩৬০ মেগাওয়াট সম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনক্ষম হয় ইরান। পরবর্তী কালে আই এ ই এ-র প্রতিবেদন এবং ২০১১ সালের ৯ নভেম্বর একটি বিশেষ প্রতিবেদনে ইরানের রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে এক বিন্দুও সরে আসবে না।’ রাষ্ট্রসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানিকে নিয়ে গঠিত ‘P5+1’-এর শেষ বৈঠকেও কোনও ঐকমত্যে পৌঁছনো যায়নি ইরানের এই কর্মসূচি বিষয়ে।
গত বছর ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র একটি প্রতিবেদনে ক্রোমিয়াম সমৃদ্ধ ইরানের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ আছে। ২০১২ সালে ইরানে নৌ-মহড়া এবং ক্ষেপণাস্ত্র ‘ক্রস জ্যাক’-ও তাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার পরমাণু বিশেষজ্ঞ স্টিফেন জিউস যে গোপন নজরদারির কথা বলেছেন, সেই নজরদারি কার্যকর করার ফলেই ক্রমে ইরানের কর্মসূচি ধীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, পাকিস্তান যদি একাধিক সন্ত্রাসবাদী দলের কর্মভূমি হয়েও তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি জারি রাখতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে এক চুল ভর্ৎসনাও না করতে পারে, তা হলে ইরানের ক্ষেত্রেই বা পরমাণু কার্যক্রম দোষের হবে কেন? এ তো মহা অন্যায়। ‘অতি দর্পে হতা লঙ্কা’ মনে আছে তো? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন প্রায় সেই দশা।

বিপক্ষে
মারণাস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা যথেষ্ট
ইরানের পরমাণু প্রকল্পটি বহির্বিশ্বের কাছে এখনও কুয়াশাচ্ছন্ন। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদ মুখে শান্তিপূর্ণ ও অসামরিক উদ্দেশ্যের কথা বললেও, তাঁর দেশ এই ব্যাপারে এক সুপরিকল্পিত গোপনীয়তা বজায় রেখে চলেছে। দেশটি আই এ ই এ-র কঠোর নজরদারির মধ্যে থাকতে সম্মত নয়। গত নভেম্বরে আই এ ই এ ইরানের গোপন ভাবে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার উদ্যোগের নতুন প্রমাণ পেশ করেছে। এক জনের অপরাধ বা অন্যায় কাজ যেমন আরেক জনের অন্যায়কে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতিপন্ন করে না, তেমনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা বা ইজরায়েলের পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ হওয়া ইরানকে একই কাজের ছাড়পত্র দিতে পারে না। বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্রের ভ্রূকুটি থেকে মুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জাতি, গোষ্ঠী, প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্বিশেষে কঠোর এবং সদর্থক ভূমিকা পালন কাম্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলিকে পরমাণু অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে চাপ দেওয়া যেমন প্রয়োজন, তেমনই নতুন ভাবে কোনও দেশ যাতে এই মারণাস্ত্র তৈরি করতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক ইরানের পরমাণু প্রকল্পে বাধাদান যুক্তিসংগত।


দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের অনতিদূরে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি যে গাড়িবোমা বিস্ফোরণ হয়, ইজরায়েলি দূতাবাসের মুখ্য নিরাপত্তা অফিসারের স্ত্রী তথা রাষ্ট্রদূত-সহ আরও চার জন ইজরায়েলি দূতাবাসকর্মী সেই দুর্ঘটনায় আহত হন। একই ভাবে ওই দিন বিস্ফোরণ হয় জর্ডনে, ব্যাঙ্ককের ইজরায়েলি দূতাবাসে পরের দিন বিস্ফোরণ হয়। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দামাস্কাসে নিহত ইরানের হিজবুল্লা গোষ্ঠীর এক কমান্ডারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দিকে দিকে ম্যাগনেটিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটল।
সুতরাং, পরমাণু প্রকল্পের গবেষণা যে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বোমা বানানোর চেষ্টাও চলবে এবং সেই বোমা এই সব সন্ত্রাসবাদীর হাতে পড়লে বিশ্বে প্রলয় বেধে যাবে, এই আশঙ্কা কি অমূলক?
প্রেসিডেন্ট মেহমুদ আহমদিনেজাদদের সমর্থকরা একের পর এক নির্বাচনে হেরে চলেছেন। তিনি এখন নিতান্তই খোঁড়া হাঁস। ওদিকে জিতে চলেছে আয়াতোল্লা খোমেইনির দল, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা তাঁরাই নির্ধারণ করবেন। এই অবস্থায় পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেললে ইরানের জঙ্গি গোষ্ঠী মারফত ইজরায়েলের বিনাশে প্রথমেই ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। তাই কড়া নজরদারির প্রয়োজন আছে। পরমাণু প্রকল্পের সার্থক রূপায়ণ না ঘটলেই মঙ্গল।
ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি (আই এ ই এ) বহুদিন ধরেই এই অভিযোগ করে আসছে। যদিও ইরান বারে বারেই তা অস্বীকার করে চলেছে। দেশটির বক্তব্য, নিউক্লিয়াস নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি (এন পি টি)-র বাইরে ওরা যায়নি। ইতিমধ্যেই ইরান চিনের কারিগরি সহায়তায় ব্যালেস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপণ করে দাবি করেছে যে এটি একটি লং ডিস্ট্যান্স মিসাইল (দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র), কার্যত যা পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম। এর থেকে নিশ্চিত হওয়া যেতেই পারে যে, ইরান শুধু পারমাণবিক শক্তি তৈরির দিকেই অগ্রসর হচ্ছে না, পরমাণু অস্ত্র বানানোর পথেও এগোচ্ছে, এবং সেই অস্ত্র ছুড়ে মারার সক্ষমতা অর্জনেরও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারের বৃদ্ধি কখনওই কাম্য নয়। ইরান একটি চরমপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্র, যারা তাদের ‘বিপ্লব’ অর্থাৎ ধর্মীয় মৌলবাদ অন্য দেশে রফতানিতে উৎসাহী। বিশ্ব-মানচিত্র থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদি রাষ্ট্রটিকে মুছে ফেলতে ইরানি প্রেসিডেন্ট আহমদিনেজাদ প্রকাশ্যেই হুমকি দিচ্ছেন। ইরানি পারমাণবিক প্রকল্পের প্রধান সহায়ক আজ পাকিস্তান, যা আর একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক দেশ।
বিশ্বের মানচিত্র বদলে ফেলার বিপজ্জনক প্রতিজ্ঞা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করে যায় যে দেশ, তার পারমাণবিক শক্তির প্রকল্পে বাধা দেওয়া মোটেও অন্যায় নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.