প্রবন্ধ... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি
দুটি বিস্ময়: অ-সাধারণ অভিজ্ঞতা
ত দূর মনে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর একটি নিবন্ধে লিটল ম্যাগাজিন-এর উল্লেখ আর কিছুটা পরিচিতি ছিল। তার আগেও অনেক ছোট ছোট সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হত, কিন্তু সেগুলির কোনও ডাক-নাম ছিল না। এখন লিটল ম্যাগাজিন বহুলপ্রচারিত। অ-ব্যবসায়িক, সাহিত্য নিয়ে অনেক পরীক্ষা, নিরীক্ষা, অপরিচিত প্রতিভাবানদের তুলে ধরা, এই সবই এ ধরনের পত্রিকার চরিত্র। বাংলা সাহিত্যের প্রবাহে লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা একটা প্রয়োজনীয় কাজ হতেই পারে। আমি অবশ্য এ দায়িত্ব নিতে পারব না, বেশ পরিশ্রম-সাধ্য এ কাজের যোগ্যতাও আমার নেই, অন্য কেউ নেবেন আশা করি।
লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে প্রকাশিত রচনার সমীক্ষা ছাড়াও এই সব পত্রিকা কারা প্রকাশ করে, পয়সা পায় কোথা থেকে, কেন কয়েক বছরের মধ্যেই এ রকম অনেক পত্রিকাই বন্ধ হয়ে যায়, হারিয়ে যায়, এ সব জানাও খুব জরুরি। প্রত্যেক পত্রিকার পিছনেই থাকে একটা ছোটখাটো গোষ্ঠী। কয়েক জন বন্ধু এবং সম-মনস্ক ছেলেমেয়ে সাহিত্যজগতে নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদেই একটা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তারা চাঁদা করে প্রেসের খরচ মেটায়। পত্রিকা প্রকাশের দিনটিতে তাদের সে কী উন্মাদনা! কয়েক সংখ্যা বেরোবার পরই এই গোষ্ঠীতে ভাঙন ধরে, ব্যক্তিত্ব বা আমিত্ব নিয়ে সংঘর্ষ হয়, বন্ধ হয়ে যায় চাঁদা দেওয়া, পত্রিকাটির অবস্থা টলমল করে। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়’, বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে এই ভাঙাভাঙির জন্য দশ বছরও লাগে না। অনেক উচ্চমানের লিটল ম্যাগাজিন চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
কোনও কোনও লিটল ম্যাগাজিনের জেদি সম্পাদক বন্ধুবান্ধবদের অসহযোগিতা সত্ত্বেও একাই পত্রিকা চালিয়ে যায় আরও কয়েকটা সংখ্যা। কোথা থেকে অর্থের সংস্থান হয়, তা অনুমান করাও শক্ত। আমি নিজেও কৃত্তিবাস পত্রিকা চালাতে গিয়ে কিছু দিনের জন্য একা হয়ে পড়েছিলাম। তখন আমি বেকার, টিউশনি করে প্রেসের ধার মেটাবার চেষ্টা করেছি, তাও পুরোপুরি মেটাতে পারিনি। বেশি ধার হয়ে গেলে প্রেস বদল করতাম। আগের প্রেসের ছায়াও মাড়াতাম না। ধরা যাক, সেই প্রেসটি মৌলালির মোড়ে, সেই মৌলালি আমার পক্ষে নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে যায়। তবে এ কথাও বলতে হয়, অনেক প্রেসের মালিক এই সব লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি সহৃদয় কোমল। এ পর্যন্ত কোনও লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি মামলা বা হামলা করেনি কেউ।
আমার লেখালেখির শুরু লিটল ম্যাগাজিন থেকেই। এখন অবশ্য অনেক পত্রিকায় লেখা দিতে পারি না। কিন্তু পড়ি। বেশ কিছু লিটল ম্যগাজিনের মান অনেক উন্নত। শুধু গল্প-কবিতা নয়, এই সব পত্র-পত্রিকায় অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ থাকে, যা বহুলপ্রচারিত পত্রিকায় পাওয়া যায় না। কিছু কিছু পত্রিকা হাতে নিয়ে আমি মুগ্ধ হই, হঠাৎ কোনও পত্রিকা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। সে রকম একটা পত্রিকা সম্পর্কে দু’চার কথা।
‘অমিত্রাক্ষর’ নামের পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় মেদিনীপুর থেকে। ‘সাহিত্য ও গবেষণামূলক নির্বাচিত বিষয়ের খেয়ালি ষাণ্মাসিক’, সম্পাদক অচিন্ত মারিক। এই সংখ্যাটি পুরোপুরি চড়াই পাখি বিষয়ে। চড়াই পাখির সংখ্যাও দ্রুত কমে যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই এ নিয়ে আলোচনা চলছে। চড়াই একটা ঘরোয়া পাখি। বড় বড় গাছে বাসা না-বেঁধে তারা মানুষের খুব কাছাকাছি থাকতে চায়। এ কালের বাড়িতে ঘুলঘুলি থাকে না, চওড়া, ঢাকা বারান্দা থাকে না, তা হলে তারা বাসা বাঁধবে কোথায়? বাইরের গাছে এই ছোট্ট সুন্দর পাখিটি বাসা বাঁধলে কাক শালিকরা এসে উৎপাত করবে। ডিম খেয়ে নেবে। পোকামাকড় মারার জন্য এখন প্রচুর কীটনাশক বিষ ছড়ানো হয়, সেই বিষাক্ত পোকামাকড় খাওয়ার ফলে চড়াই পাখিদের নির্ঘাত মৃত্যু। এমনকী এখন মোবাইল ফোনের সংখ্যা এত বেশি বাড়ছে, তাদের তরঙ্গের ম্যাগনেটিক এফেক্টেও এদের ছোট প্রাণ টিকে থাকতে পারছে না। পৃথিবীতে কত রকম চড়াই আছে, তার সচিত্র বিবরণ এবং বাইবেল থেকে শুরু করে সালিম আলির রচনায় চড়াই পাখির উল্লেখও সংগৃহীত হয়েছে এই সংখ্যায়।
গ্রামাঞ্চলে তবু এখনও কিন্তু চড়াই দেখা যায়। কিন্তু বড় বড় শহরে মানুষের সব থেকে চেনা এই পাখিটি একেবারে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
রচনাগুণে এই পত্রিকাটি বিশেষ সমৃদ্ধ তো বটেই, তা ছাড়াও আমি মুগ্ধ হয়েছি এই সংখ্যাটির নির্মাণকুশলতা দেখে। অনেক রকমের ছবি, প্রতিটি পৃষ্ঠার লে-আউটও অনবদ্য। শহরের অনেক বড় পত্রিকাকেও অঙ্গসজ্জায় হার মানিয়ে দেবে।
অমিত্রাক্ষর পত্রিকা ও তার সম্পাদককে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই।

আমি নাট্যবিশারদ বা নাট্যসমালোচক নই। নাটক দেখতে ভালবাসি। দর্শক হিসাবে আমার তিন রকম অভিজ্ঞতা হয়। কিছু কিছু নাটক দেখে মন ভরে যায়। সময়টা বেশ ভাল কাটে। দু’একটি নাটক বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে ও প্রয়োগে এবং অভিনয়ে এতই উচ্চাঙ্গের যে বাইরে এসে অনেকের সঙ্গে সেই নাটকটি নিয়ে অনেকক্ষণ মত বিনিময় করা যায়। আর দৈবাৎ দু’একটি নাটক (এ দেশে বা বিদেশে) দেখতে দেখতে মুগ্ধতার চেয়েও বিস্ময়বোধ বাড়তে থাকে। বেশ ভাল কিংবা ততটা সার্থক নয়, এই বিচারও মনে আসে না।
এই তৃতীয় ধরনের অনুভূতির নাটক ইটসি বিটসি। এই শিরোনামের মানে যে জানতেই হবে, তারও কোনও মানে নেই। এখন গ্রুপ থিয়েটারের বেশ কয়েকটি নাটকই সার্থক, গর্ব করার মতো। তবে সে সব নাটকের কাহিনিতে একটা ধারাবাহিকতা থাকে। কিন্তু নাটকটির প্রথম কয়েকটি দৃশ্য দেখার পরই মনে প্রশ্ন জাগে যে, সত্যিই কি কলকাতার কোনও মঞ্চে এ রকম নাটক দর্শকদের চক্ষু ও কর্ণ টেনে রাখতে পারে? এ নাটকে দৃশ্যের পর দৃশ্যের কোনও পারম্পর্য নেই। এর গঠন অনেকটা বিমূর্ত ধরনের।
বিমূর্ত আঙ্গিকের নাটক মঞ্চস্থ করা বেশ ঝুঁকিবহুল। কারণ, মঞ্চ ও অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলেও দর্শকবৃন্দ কাহিনিটি অনুসরণ করতে চায়, নচেৎ এক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে।
আশ্চর্য ব্যাপার, এ নাটকে সে রকম কিছু ঘটেনি, বরং মাঝে মাঝেই দর্শকদের উষ্ণ সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া গেছে হাত চাপুড়িতে।
যে হেতু এ নাটকে টানা কোনও কাহিনি নেই, তাই গল্পের চুম্বক দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মূল চরিত্র, দুই ভাই, বড় ভাইটি খানিকটা পাগলাটে, প্রতিভাবান, রাজনীতির দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ, আর ছোট ভাইটি চতুর, সমসাময়িক ব্যবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চায়।
বড় ভাইয়ের ভূমিকায় গৌতম হালদার অভিনয় সাফল্যে তাঁর জীবনে আর একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। আর অন্য ভাইয়ের ভূমিকায় স্বল্প পরিচিত চিরঞ্জীব বসু, সে-ই নাট্যকার। তার সাবলীল অভিনয় এবং এ রকম একটি নাটক রচনায় যে সাহসের পরিচয় দিয়েছে সে জন্য তাকে বিশেষ সাধুবাদ জানাতে হয়।
হাতে খড়ি নামে নতুন সংস্থার প্রযোজনায় এবং দেবাশিস ঘোষ দস্তিদারের পরিচালনায় এই নাটকটি সত্যিই অসাধারণ।
নাটকটিতে রাজনীতির কিছ কিছু স্পর্শ আছে। তার চেয়েও বেশি আছে মানব-সম্পর্কের অন্দরমহলের কথা। সেখানেও মাতিয়ে দিয়েছে দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত।
এ নাটক অবিস্মরণীয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.