অর্থবল অপেক্ষা বল নাই। মনমোহন সিংহ তাহা জানেন বলিয়াই নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন যে, ইতিহাস জওহরলাল নেহরুকে যে স্থান দেয় নাই, তাঁহার জন্য সেই আসন সাজাইয়া রাখিয়াছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় একটি সম্মানের আসন অর্জন করিয়াছিল ঠিকই, কিন্তু তাহা দ্বিমেরু বিশ্ব-রাজনীতির কল্যাণে। ভারত তখন আর্থিক শক্তি হিসাবে অকিঞ্চিৎকর ছিল। যে দেশের অন্নসংস্থান অন্য দেশের বদান্যতার উপর নির্ভর করিয়া থাকে, জগৎসভায় তাহার উচ্চ আসন জুটিতে পারে না। আজ যখন ব্রিকস-এর মঞ্চে দাঁড়াইয়া মনমোহন সিংহ ঘোষণা করিয়া দেন যে ভারত, এবং ব্রিকস-এর অন্যান্য সদস্য দেশ, ইরানের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিবে না তখন তাঁহার গুরুত্ব পণ্ডিত নেহরুর তুলনায় বেশি। এই গুরুত্ব একবিংশ শতকের ভারতের, যে দেশটি ক্রমে অর্থনৈতিক বিশ্বশক্তি হইয়া উঠিতেছে। ব্রিকস-এর সকল সদস্য দেশের, এবং সমগ্র সংগঠনটির গুরুত্বের কেন্দ্রেই এই অর্থনৈতিক উত্থান। কূটনীতির মঞ্চের উচ্চাবচ সম্পর্ক অর্থনীতির ময়দানে নির্ধারিত হইবে, ইহাই একুশ শতকের সত্য।
ব্রিকস-এর পাঁচটি দেশে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের বাস। ফলে, বাজার হিসাবে ব্রিকস-এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পাঁচ দেশের মিলিত অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৪ লক্ষ কোটি ডলার। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে প্রায় চার লক্ষ কোটি ডলার। এই দেশগুলিকে, বিশেষত চিন ও ভারতকে বাদ রাখিয়া বিশ্বমঞ্চে কোনও যজ্ঞই আর আয়োজিত হইতে পারিবে না। ব্রিকস-এর মঞ্চের গুরুত্ব এইখানেই। জোটটির ইতিহাস বিশেষ প্রাচীন নহে। কিন্তু, জন্মলগ্ন হইতেই এই জোটটিকে লইয়া বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল। যেমন, চিন ও ভারতের ন্যায় দুইটি দেশ, যাহারা পারস্পরিক সন্দেহের আবহে বাস করিতেই অভ্যস্ত, তাহারা কি কূটনীতির মঞ্চে একমত হইতে পারিবে? দেখা গেল, অর্থনীতির যুক্তি আর সব বিবেচনাকেই পিছনে ফেলিয়া দিতে পারে। তাহা পারিয়াছে বলিয়াই ইরান-প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও সংযত আছে। সিরিয়া-প্রশ্নেও ব্রিকস-এর অবস্থান আন্তর্জাতিক মঞ্চে যথেষ্ট গুরুত্বের সহিত বিবেচিত হইতেছে। ব্রিকস-এর অবস্থানের একটি বড় কারণ সদস্য দেশগুলির অর্থনৈতিক স্বার্থ। সেই স্বার্থের কথা প্রথম বিশ্বকে মানিতে বাধ্য করিবার মতো কূটনৈতিক জোরও অর্থনীতির মাধ্যমেই অর্জিত হইয়াছে।
এই কারণেই ব্রিকস-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আর দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। ব্রিকস-ব্যাঙ্ক এখনও সম্ভাবনামাত্র, কিন্তু ব্রেটন উডস-জাত প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিস্পর্ধী দক্ষিণ-দক্ষিণ প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাটিকে বাঁচাইয়া রাখাও কিছু কম প্রাপ্তি নহে। সদস্য দেশগুলি পরস্পরের মধ্যে ঋণ দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করিবার কথা ভাবিয়াছে। উন্নয়নের কাজে একজোট হইয়া অগ্রসর হওয়ার কথাও বলা হইয়াছে। প্রস্তাব ও বাস্তবের মধ্যে নিশ্চয়ই বহু যোজন ফারাক, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কত পথ অতিক্রম করিয়াছে তাহাই একমাত্র বিবেচ্য নহে, তাহার পক্ষে কত দূর যাওয়া সম্ভব এবং সম্ভাব্য, তাহাও জরুরি। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ব্রিকস যতখানি বর্তমান, তাহার অনেক বেশি ভবিষ্যৎ। ব্রিকস-এর সদস্য দেশগুলি পরস্পরকে বাড়িতে সাহায্য করিলে তাহার ‘সিনার্জি’ বা ইতিবাচক অতিক্রিয়া আছে। বর্ধিত অর্থনৈতিক শক্তি কূটনৈতিক জোর বাড়াইবে। তাহাতে ফের অর্থনীতির পালেই হাওয়া লাগিবে। |