আদর্শ অতি উৎকৃষ্ট বস্তু, কিন্তু বাস্তবকে অস্বীকার করিয়া তাহার ভজনা করিতে চাহিলে সঙ্কট অনিবার্য। শিল্প, পরিকাঠামো ইত্যাদির জন্য জমি সংস্থানের প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনই সঙ্কটে পড়িয়াছেন। উভয়সঙ্কট। এক দিকে তিনি ঘোষণা করিয়াছেন যে সরকার জোর করিয়া কৃষি জমি অধিগ্রহণ করিবে না। তাহা হইলে কৃষি ভিন্ন অন্য কাজে জমির প্রয়োজন মিটিবে কী উপায়ে? যাঁহার জমি প্রয়োজন, তিনি যদি বাজারে জমি কিনিতে পারেন, তবে গোল চুকিয়া যায়। কিন্তু সেখানেও দুইটি বড় সমস্যা। এক, পশ্চিমবঙ্গের জমির মালিকানা এত বেশি খণ্ডিত যে বড় মাপের জমি বাজার হইতে কেনা দুঃসাধ্য। দুই, এই রাজ্যে আজও প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিধি বলবৎ রহিয়াছে শহরে ও গ্রামে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন অন্য রাজ্যে উঠিয়া গেলেও পশ্চিমবঙ্গে তাহা সগৌরবে বহাল। ফলে, জমি কিনিতে পারিলেও তাহা ওই আইনের ঊর্ধ্বসীমায় ঠেকিয়া যায়। অতএব সরকারও জমি অধিগ্রহণ করিবে না, বেসরকারি ক্রেতাও যথেষ্ট জমি কিনিতে পারিবে না। এখানেই উভয়সঙ্কট। যত দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তত দিন জমির প্রশ্নে তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের নাজেহাল করিয়াছেন। কিন্তু কিঞ্চিদধিক দশ মাস তিনি মুখ্যমন্ত্রী, তাঁহার দল প্রধান শাসক দল। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পাদি কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগের বিবিধ প্রস্তাব জমির সমস্যায় ঠেকিয়া যাইতেছে। অতএব, বুমেরাং-এর মুখে পড়িয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভূমি সংস্কার আইনে সংশোধন ঘটাইয়াছে। সংস্কারের মূল লক্ষ্য: বিনিয়োগকারী যেন প্রয়োজনীয় জমি সংগ্রহ করিতে পারেন। এই লক্ষ্য পূরণে সরকার অন্তত কিছুটা অগ্রসর হইয়াছে। আইন সংশোধনে বিনিয়োগকারীদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াও তাহাই বুঝাইয়া দেয়। মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। ইহা জরুরি পদক্ষেপ।
কিন্তু যথেষ্ট নয়। জমির সমস্যাটিকে যখন তিনি স্বীকারই করিয়াছেন, তখন তাহার আমূল সমাধান বিধেয় ছিল। তাহার উপায়: জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত আইনের সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন। এই আইন কেবল অন্যান্য অধিকাংশ রাজ্যেই বাতিল হয় নাই, কালের নিয়মে ইহা সমস্ত যৌক্তিকতা হারাইয়াছে। এক কালে ভারতে শিল্পসংস্থার আয়তনের উপরেও ঊর্ধ্বসীমা জারি ছিল, সমাজতন্ত্রের মোহে আবিষ্ট রাষ্ট্রনায়করা ভাবিতেন, কেবল রাষ্ট্রই বৃহৎ হইবে, আর সকলই ক্ষুদ্র। সেই দিন গিয়াছে, শিল্পবাণিজ্যের ভারতে বৃহৎ এখন আর নিন্দিত নয়, বন্দিত। এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও। কিন্তু জমির ক্ষেত্রে এই রাজ্যে আজও ক্ষুদ্রই সুন্দর। বামফ্রন্ট ভূমি সংস্কারের ভুল মন্ত্রের প্ররোচনায় ক্ষুদ্রতার সাধনা জারি রাখিয়াছিল, রাজত্বের শেষ বেলায় যখন সেই সাধনা শিল্পায়নের পথে বাধা হইয়া দাঁড়ায়, তখন অধিগ্রহণের পথে সেই বাধা অতিক্রম করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। অনাচারী দল এবং অক্ষম প্রশাসনের দ্ব্যহস্পর্শে সেই প্রয়াস বিফল হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাজনীতির সওয়ার, তাহা হয়তো তাঁহাকে অধিগ্রহণের প্রয়োজন মানিতে দিবে না, অন্তত আপাতত। কিন্তু সেই কারণেই তাঁহার কর্তব্য, জমির বাজারটিকে উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, মা মাটি মানুষ একটি স্লোগানমাত্র, কৃষির স্বতন্ত্র কোনও মাহাত্ম্য নাই, শিল্প, বাণিজ্য বা পরিষেবার মতোই কৃষিও অর্থনীতির একটি ক্ষেত্র বই কিছু নয়। কোনও জমিতে কৃষি যদি লাভজনক হয়, সেখানে কৃষিকাজ হইবে, যদি সেই জমির অন্য কোনও অধিকতর লাভজনক ব্যবহার থাকে, তবে কৃষির বদলে তাহাই সেখানে বিধেয়। ইহার জন্য জোর জবরদস্তির প্রয়োজন নাই, ক্রেতা ও বিক্রেতার চাহিদা এবং জোগানই জমির ভবিতব্য নির্ধারণ করিবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষকের উপর জোর করিতে চাহেন না, বাজারের উপরেই বা জোর করিবেন কেন? |