মমতার দাবি মেনে এনসিটিসি নিয়ে পৃথক বৈঠক |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) গঠন নিয়ে আলোচনা করতে পৃথক বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্ত নিল মনমোহন সিংহের সরকার। এই সিদ্ধান্ত সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পরে চিদম্বরম জানান, এনসিটিসি নিয়ে ৫ মে দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠক হবে।
গোড়ায় ঠিক ছিল, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে ১৬ এপ্রিল দিল্লিতে ডাকা মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনেই আর পাঁচটা বিষয়ের সঙ্গে এনসিটিসি নিয়ে আলোচনা করবে কেন্দ্র। কিন্তু কেন্দ্রের সেই চিঠি পেয়েই আপত্তি তোলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তিনি দাবি করেন, এনসিটিসি গঠনের মাধ্যমে রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠকে বসুক কেন্দ্র। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠকে অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। পরে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেন। তিন মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি আজ মেনে নেন মনমোহন।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এনসিটিসি গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজ্যের সঙ্গে আগাম আলোচনা না করেই কেন এগিয়েছিল কেন্দ্র? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের অভাবের ছবিটাই বা বারবার উঠে আসছে কেন? জবাবে চিদম্বরম আজ বলেন, “আগাম আলোচনা না হওয়ার ধারণা ভ্রান্ত। কেন্দ্র কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কখনও রাজনৈতিক স্তরে আলোচনা করে, কখনও কেন্দ্র-রাজ্য আমলাস্তরে আলোচনা হয়, কখনও বা আলোচনা হয় সরকারি স্তরে। কিন্তু তার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর যদি কারও মনে সন্দেহ জাগে, তা হলে ফের আলোচনা জরুরি। এটাই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।”
বস্তুত রাজ্য পুলিশকে এড়িয়ে এনসিটিসি-কে গ্রেফতার ও তল্লাশি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া নিয়ে প্রথম থেকেই সরব ছিলেন মমতা। নবীন পট্টনায়ক, নরেন্দ্র মোদী, নীতীশ কুমার-সহ প্রায় এক ডজন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। মুখ্যমন্ত্রীদের সেই আপত্তির জন্যই ১ মার্চ থেকে এনসিটিসি চালু করা যায়নি।
শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রীদের আলাদা বৈঠক ডাকতে রাজি হলেও এনসিটিসি গঠনের ব্যাপারে চিদম্বরম তথা মনমোহন-সরকার কিন্তু এখনও অবিচল। আজ কংগ্রেসের মুখপত্র ‘সন্দেশে’ও এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের বিরোধিতাকে কার্যত এক হাত নিয়ে বলা হয়েছে, ‘এনসিটিসি গঠনের বিষয়টি একটি সুচিন্তিত প্রস্তাব। সুশাসনের প্রথম শর্তই হল, দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। অথচ এ ব্যাপারে যেন বিরোধিতা করার জন্যই বিরোধিতা করা হচ্ছে!’ এই প্রসঙ্গে কংগ্রেস মুখপত্রে আজ নবীন পট্টনায়কের সরকারের সমালোচনাও করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এক দিকে মাওবাদীদের হাতে বিদেশি নাগরিক ও দলের বিধায়ক অপহৃত হওয়ার ঘটনায় নবীন-সরকার কেন্দ্রের সাহায্য চাইছে, অন্য দিকে এনসিটিসি-র বিরোধিতা করছে। কংগ্রেসের বক্তব্য, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করছে বলে এনসিটিসি গঠন নিয়ে কিছু রাজ্য আপত্তি করছে ঠিকই, কিন্তু এই কেন্দ্র গঠন করা এখন সময়ের দাবি। তাই রাজ্যগুলির উচিত কেন্দ্রকে সমর্থন করা’।
সর্বসম্মতি গড়ে তোলার সেই লক্ষ্য নিয়েই চিদম্বরম আজ জানান, এনসিটিসি গঠনের জন্য একটি ‘নোট’ মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাঁর কথায়, “আশা করছি, বৈঠকের আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর’ (এসওপি)-র খসড়া রচনা করতে পারবে। ৫ মে-র বৈঠকের আগে তা মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে পাঠানো হবে। ওই দু’টি নোটের ভিত্তিতেই আলোচনা হবে।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, এনসিটিসি-র হাতে তল্লাশি ও গ্রেফতারের অধিকার থাকা নিয়ে রাজ্যগুলির যে উদ্বেগ, তা কাটাতে ইতিমধ্যেই এক দফা চেষ্টা করেছে কেন্দ্র। প্রস্তাবিত ‘এসওপি’ রাজ্যের উদ্বেগ আরও কমাবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আশাবাদী। পাশাপাশি চিদম্বরম আজ জানান, যুক্তিসঙ্গত পরিমার্জন ও সংশোধনেও কেন্দ্রের আপত্তি নেই।
চিদম্বরম আজও এনসিটিসি গঠনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। তাঁর বক্তব্য, কার্গিল যুদ্ধের পর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে তদানীন্তন সরকারের এক মন্ত্রিগোষ্ঠীর সুপারিশ ছিল, একটি মাল্টি এজেন্সি সেন্টার, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি টাস্ক ফোর্স এবং একটি আন্তঃরাজ্য গোয়েন্দা সাপোর্ট সিস্টেম গঠন করা উচিত। পরে দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিটিও এনসিটিসি গঠনের প্রস্তাব দেয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তথা চিদম্বরমের বক্তব্য, এনসিটিসি কোনও পৃথক আইন করে তৈরি হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই যে ইউএপিএ রয়েছে, তার আওতাতেই কাজ করবে এনসিটিসি। ওই আইনের ৪৩এ ধারায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে তল্লাশি ও গ্রেফতারের অধিকার দেওয়া রয়েছে। এই ধারাটি নিয়ে এখন বিতর্ক হচ্ছে ঠিকই, অথচ ৪৩বি ধারায় এ-ও বলা রয়েছে যে, তল্লাশির পর বা কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর বিলম্ব না করে স্থানীয় থানার ওসি-র কাছে তা জানাতে হবে। সুতরাং রাজ্যকে অন্ধকারে রাখার প্রশ্ন উঠছে না। বড় কথা হল, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন সংসদে ইউএপিএ আইনটি সংশোধন করে এই ধারাগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন কিন্তু কোনও দলই আপত্তি করেনি। তা ছাড়া, ইউএপিএ-র আইনি যোগ্যতা নিয়ে কিন্তু অতীতের টাডা-পোটা-র মতো প্রশ্ন উঠছে না।
পাল্টা জবাবে বিজেপির বক্তব্য, মুম্বই সন্ত্রাসের পর দেশ জুড়ে জাতীয়তাবাদের আবেগ থাকার কারণেই তাঁরা ইউএপিএ আইন সংশোধনে সায় দিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রের নোটিফিকেশনই জানাচ্ছে যে, এনসিটিসিকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর অধীনে রাখা হচ্ছে। বিজেপি-র প্রশ্ন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে কী ভাবে গ্রেফতার ও তল্লাশির অধিকার দেওয়া যায়? এ নিয়ে আজ চেন্নাইয়ে মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার সঙ্গে বৈঠক করেন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি। রাজনৈতিক দলগুলির বক্তব্য, এই যুক্তিকে সামনে রেখেই মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনে জয়ললিতা, নরেন্দ্র মোদী, নীতীশ কুমাররা কেন্দ্রকে চাপে ফেলতে পারে।
তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, বাজপেয়ী জমানার মন্ত্রিগোষ্ঠীর সুপারিশ ছিল যে, সন্ত্রাস দমন প্রতিরোধ ও সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ এবং আদানপ্রদানের জন্য ‘নোডাল এজেন্সি’ হওয়া উচিত কেন্দ্রীয় সংস্থারই। ইউপিএ সরকার সেটাই করেছে। তা ছাড়া, সন্ত্রাস দমনে নিযুক্ত অফিসারের হাতে তল্লাশি ও গ্রেফতারের অধিকার থাকা ন্যূনতম প্রয়োজন। তা না হলে এনসিটিসি কখনওই কার্যকরী হয়ে উঠতে পারবে না।
রাজ্যগুলিকে আশ্বস্ত করতে চিদম্বরম আজ বলেন, “এনসিটিসি-র কাজই হবে সন্ত্রাস দমন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এনসিটিসি-র একটি স্থায়ী পরিষদ থাকবে। এনসিটিসি-র ডিরেক্টর ও তিন জন জয়েন্ট ডিরেক্টর ছাড়াও সব রাজ্যের সন্ত্রাস দমন শাখার কর্তারা থাকবেন ওই পরিষদে।” যার অর্থ, রাজ্যকে না জানিয়ে কিছুই হবে না।
তবে শেষ পর্যন্ত রাজ্যগুলি কেন্দ্রের এই যুক্তি মানতে রাজি হবে, না কি কেন্দ্রকে এনসিটিসি গঠন থেকে পিছু হটতে হবে, এখন সেটাই দেখার। |