কঠিন বাস্তব ও আকাশ-কুসুম স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য কতটা?
সিপিএমের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ২০-তম পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য ঠিক যতটা।
আগামী কাল কেরলের পশ্চিমে সমুদ্র উপকূলবর্তী কোঝিকোড় শহরে পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধন হচ্ছে। তার আগের দিন সন্ধ্যায় কোঝিকোড়ের সমুদ্রতটে প্রায় আইপিএল টুর্নামেন্টের ছায়া দেখা গেল। আতসবাজি, মশাল মিছিল, রঙিন বেলুনের ওড়াউড়ি, নাচ-গান-বাজনা, বিশাল স্তম্ভের উপর লাল ঝান্ডা, গোটা কোঝিকোড়ের বিচ এ মাথা থেকে ও মাথা লাল পতাকায় মুড়ে দেওয়া সব মিলিয়ে সিপিএম ঠিক কী হতে চাইছে সেটাই কোঝিকোড় শহর কব্জা করে দেখাতে চাইল প্রকাশ কারাটের দল।
কিন্তু বাস্তবটা কি?
সেটা হল, গোটা দেশে সিপিএম যখন কোণঠাসা, তখন আবার দলের সেই মূল জনভিত্তি কৃষকদের মন পাওয়ার জন্য জমি নিয়ে কট্টর অবস্থানে ফিরতে চাইছে সিপিএম।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন শিল্পের জন্য জমি লেনদেনের ক্ষেত্রে আইনি বাধা সরিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু সিপিএম মমতাকে তাঁর পুরনো ‘বামপন্থী’ অবস্থানেই বেঁধে রাখতে চায়। জমি অধিগ্রহণ হোক বা ভূমি-সংস্কার আইনের সংশোধন, পার্টি কংগ্রেসে সিপিএম কৃষকদের জমি কেড়ে নেওয়ার বিরোধী কট্টর লাইন নিতে চাইছে।
পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে সিপিএম যে ভুল করেছিল, তাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। এখন জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে সিপিএম মমতার বিরুদ্ধেই পাল্টা কট্টর অবস্থান নিচ্ছে। কোঝিকোড়ে এসে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের এক পোড়খাওয়া নেতার সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, “উঁচু পাহাড়ে ওঠার সময় যখন আবহাওয়া খারাপ হয় বা তুষার ঝড় ওঠে, তখন দ্রুত বেস ক্যাম্পে ফিরতে হয়। বেস ক্যাম্পেই ঘাঁটি আঁকড়ে ধরে বসে ভাল আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এখন আমাদের সেই বেস ক্যাম্পে ফেরার সময়।” গত কাল পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভূমি-সংস্কার আইনে সংশোধনী এনেছে। যার মধ্য দিয়ে নতুন শিল্পায়ন বা পুরনো শিল্পের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে জমির ঊর্ধ্বসীমার সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। সিপিএম কিন্তু ফের বিরোধিতা করছে। দলের নেতারা বলছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন চাষের জমি অধিগ্রহণ না করার কথা বলছেন, তখন তিনিই আবার সেই চাষের জমি শিল্পপতিদের হাতে অবাধে তুলে দিতে চাইছেন। এই বিষয়টি নিয়ে আগামী দিনে গ্রামে গ্রামে প্রচারে নামতে চাইছে সিপিএম।
কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসে রাজনৈতিক দলিলের সেই জমি অধিগ্রহণ বিরোধিতারই কট্টর লাইন। মমতার আপত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারের জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিল আটকে রয়েছে। একই ভাবে সিপিএমও ওই বিলের বিরোধিতা করছে। পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক খসড়ায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিলে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের কথা বলা নেই। ফলে, কৃষকদের কোনও লাভ হবে না। এবং বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও শর্তই বাধ্যতামূলক করা হয়নি। দলের কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে সিপিএমের শীর্ষ নেতারা এক দিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে দরবার করছেন। সেই সঙ্গে সারা দেশে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে কী ভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে আগামী কাল থেকে শুরু হতে যাওয়া পার্টি কংগ্রেসে আলোচনা করতে চলেছেন। এর ধাক্কা মহাকরণে গিয়েও লাগবে বলে মনে করছেন সিপিএম নেতারা।
তিন রাজ্যের বাইরে দলের সংগঠন বিস্তার করতে আদিবাসী ও দলিতদের স্বার্থরক্ষাকারী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে সিপিএম। এবং সেখানেও আদিবাসী-দলিতদের মন জিততে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতাই মূল পাথেয় সিপিএমের কাছে। দলের নেতারা বলছেন, কেন্দ্রের যে জমি অধিগ্রহণ বিল আছে, সেখানে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়া বা তাদের নিজস্ব এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার এবং তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটা নিয়েও সরব হতে চাইছে সিপিএম।
সমস্যা একটাই। বাস্তবের সঙ্গে সেই চাহিদা বা উচ্চাশার ফারাক। জমি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পশ্চিমবঙ্গ বা হিন্দি বলয়ে যে সাংগঠনিক জোর দরকার তা এই মুহূর্তে নেই। পশ্চিমবঙ্গে সংগঠনকে ফের চাঙ্গা করার চেষ্টা চলছে। যাঁরা আন্দোলন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরা আস্তে আস্তে আবার ফিরে আসছেন বলে মনে করছেন আলিমুদ্দিনের নেতারা। রাজ্য নেতাদের বক্তব্য, সময় লাগবে। কিন্তু আস্তে আস্তে হওয়াই ভাল। হিন্দি বলয়ে তো সংগঠন গড়েই ওঠেনি। কেরলে পিনারাই বিজয়নদের সে সমস্যা নেই। তাই দক্ষিণের এই রাজ্যে ক্ষমতায় না থাকলেও সংগঠনের জোরে পার্টি কংগ্রেসের জন্য ঝাঁ চকচকে আয়োজন করতে পারেন তাঁরা। আজ তারই সাক্ষী হয়ে রইল কোঝিকোড়। |