মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাল কেটে এগোচ্ছে কমিউনিস্ট-বোঝাই একটা ট্রলি বাস। হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলছেন, “সকলকেই এক জায়গায় পেয়ে গেলাম তা হলে!” পাশ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেবের সংযোজন, “আমাদের আরও একটা বড় দল কিন্তু রবীন দেবের নেতৃত্বে ট্রেনে রওনা হয়ে গিয়েছে আগেই। স্টেশনে স্টেশনে দাঁড়াচ্ছে আর ফোন হচ্ছে! বিমানে এ সব নেই। ওঠো আর নামো। মাঝে কিছু নেই!” মানিক এ বার বললেন, “আমার রাজ্যে তো বিমানই ভরসা!” কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই অনাবিল একটা হাসি এল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর থেকে!
মুম্বই থেকে কোঝিকোড় উড়ান-পথেও হাসির ধারা অব্যাহত। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, দিল্লি, হায়দরাবাদ, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ, পঞ্জাবের প্রতিনিধিদের গোটা বিমান ছেয়ে থাকতে দেখে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হান্নান মোল্লা সহাস্য স্বগতোক্তি করলেন, “অল রোডস লিড টু সোশ্যালিজম!” কোঝিকোড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের লাউঞ্জে পা রাখা মাত্র লাল রিবন হাতে ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ এবং বাইরে ক্যানেস্তারার সহর্ষ অভ্যর্থনা পর্যন্তও এই ফুরফুরে মেজাজই বহাল থাকল। কোঝিকোড় সমুদ্র সৈকতে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিপুল আতসবাজির ঢেউ পরিবেষ্টিত হয়ে পতাকা উত্তোলন সেরে কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন বলেই দিলেন, “মহাসমারোহে উদযাপিত হোক এই পার্টি কংগ্রেস!” |
কিন্তু শুধুই কি সমারোহ? সমারোহের পিছনে তো অর্থের জোগানও লাগে! সিপিএমের ‘সমৃদ্ধতম’ রাজ্য হিসাবে কেরলের না-হয় তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু দেশের নানা প্রান্ত থেকে ৭৩৪ জন প্রতিনিধি এবং ৭০ জন পর্যবেক্ষক তো আসলে জড়ো হয়েছেন নিজেদের রেস্ত-র হিসাব বুঝে নিতে! পার্টি কংগ্রেসই সিপিএমের কর্মীদের ‘পারফরম্যান্স’ যাচাই এবং তার অপরিহার্য অনুষঙ্গে ভাতা সংশোধনের সময়। দেশের নানা প্রান্ত থেকেই দলের মধ্যে দাবি উঠেছে,শুধু মতাদর্শগত দলিল সময়োপযোগী করলে চলবে না। সর্বক্ষণের কর্মীদের ভাতাও ‘যুগোপযোগী’ করতে হবে! কলকাতা জেলা সম্মেলন থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্মেলন হয়ে সেই দাবি এ বার ছড়িয়ে পড়ার পালা পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চেও। এবং সিপিএম নেতৃত্বও এ বার দাবির যথার্থতা মেনে নেওয়ার পথে।
কোনও রাজ্যেই দলের সর্বক্ষণের কর্মীদের ভাতা যাতে সেই রাজ্যের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির থেকে কম না-হয় এই মর্মেই এ বারের পার্টি কংগ্রেস থেকে রূপরেখা বেঁধে দেওয়া হতে পারে বলে সিপিএম সূত্রের ইঙ্গিত। আয়োজক রাজ্য কেরল ইতিমধ্যেই পথ দেখিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারির রাজ্য সম্মেলন থেকে তারা সর্বক্ষণের কর্মীদের ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলে পদমর্যাদা এবং ‘সিনিয়রিটি’র ভিত্তিতে সর্বক্ষণের কর্মীরা মাসে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা পাচ্ছেন এখন। কিন্তু কেরলের ভাঁড়ারে যা আছে, সব রাজ্যের তা নেই। আবার ভাতা পুনর্বিবেচনা না-করলে বাকি রাজ্যগুলোতে পার্টি করার লোক জোগাড় করা মুশকিল। তাই ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে সাযুজ্য টেনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বকে।
কোঝিকোড় আসার পথে দিল্লি থেকে দলের এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সরাসরিই বলছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গ, কেরল বা ত্রিপুরায় দলে লোক ধরে রাখার বা নতুন লোক টানার একটা বড় ইনসেনটিভ আছে। ওই তিন রাজ্যে দলটা কখনও ক্ষমতায়, বা নিদেনপক্ষে প্রধান বিরোধীর আসনে থাকবে। ভাতাই সেখানে একমাত্র প্রশ্ন নয়। কিন্তু হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতে মাসে ৫০০ বা হাজার টাকা দিয়ে কাঁহা তক কর্মীদের ধরে রাখা যায়? বাজারদর তো কমিউনিস্টদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে না!” কেবল বিপ্লবের স্বপ্ন যে লাল ঝান্ডা বহন করার কর্মী জোটানোর একমাত্র দাওয়াই নয়, এ বার কি তা হলে তাঁদের মালুম হতে শুরু করেছে? বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গের মতো বড় রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পর? পলিটব্যুরোর এক সদস্যের মতে, “ঠিক ও ভাবে দেখা ঠিক নয়। আমরা তো বাস্তববর্জিত দল নই! সর্বক্ষণের কর্মীরা দলের সম্পদ। তাঁদের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি বিবেচনা করার জায়গা পার্টি কংগ্রেসই।”
পার্টি কংগ্রেসের শহর দেখলে অবশ্য ‘স্বাচ্ছন্দ্য’ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা আছে বলে মনেও হবে না! শহরের বাইরে বিমানবন্দর থেকে শহরের কেন্দ্রস্থলে মূল বাস টার্মিনাস একটা বাতিস্তম্ভও মিলবে না, যেখানে সম্মেলনের পতাকা উড়ছে না! ৫০ মিটার দূরে দূরে পার্টি কংগ্রেসের লোগো সম্বলিত স্ট্যান্ড। যে প্রেক্ষাগৃহে মূল সম্মেলন, সেই ‘টেগোর সেন্টিনারি হল’ আক্ষরিক অর্থেই ‘লাল দুর্গে’র চেহারা পেয়েছে! নাম হয়েছে ‘জ্যোতি বসু-হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ নগর’। প্রেক্ষাগৃহের পাড়াতেই একটা প্রাঙ্গনে চাঁদোয়া খাটিয়ে মিডিয়ার জন্য হরেক কিয়স্ক। কোঝিকোড় সৈকতে বাঁশ-কাপড়ের দশাসই খিলান তুলে প্রকাশ্য সমাবেশের মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের দিশানির্ণয়ের সম্মেলন শুরু হওয়ার আগের সন্ধ্যাতেও টাউন হলে প্রকাশ কারাট বক্তৃতা করেছেন সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যতের উপরে।
সে তো তত্ত্বের কথা! কারাট অবশ্য জানেন, কার্ল মার্ক্সের চেয়েও বেশি এখন তাঁর মনে পড়ার কথা অমিত মিত্রকে! কর্মীদের ভাতা বাড়াতে গেলে আয়ও যে বাড়াতে হয়, অন্য পেশায়-থাকা কর্মীদের থেকে আদায়ে জোর দিতে হয় এ সব তাঁরও জানা। কিন্তু বঙ্গের অর্থমন্ত্রীর মতোই কারাট এ-ও বোঝেন, অর্থচিন্তা চমৎকারা হতে পারে। কিন্তু সহজ নয় মোটেও! |