দলিলে একনায়কতন্ত্রের কথা
মুছে পরিবর্তন আনছে সিপিএম
সিপিএমে এ বার ‘পরিবর্তন’-এর হাওয়া।
মার্কসবাদের তাত্ত্বিক সৌধ সর্বহারার একনায়কতন্ত্র। কমিউনিস্ট ইস্তাহারে মার্কস লিখেছিলেন, ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে বিনাশ করে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে হবে’। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে সেই একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সমাজতন্ত্র যখন সাম্যবাদে পৌঁছবে, তখন একটাই শ্রেণি থাকবে। সর্বহারা শ্রেণি। একটাই দল থাকবে। কমিউনিস্ট পার্টি। সংবাদমাধ্যমও হবে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত।
আগামিকাল কেরলের কোঝিকোড়ে শুরু হতে চলা সিপিএমের ২০তম পার্টি কংগ্রেসে যে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক দলিল পেশ হবে, কেন্দ্রীয় কমিটি গৃহীত সেই প্রস্তাবে কিন্তু এ বার এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। ‘একনায়কতন্ত্র’ শব্দটি মুছে দেওয়া হচ্ছে দলিল থেকে। একনায়কতন্ত্র এবং একদলীয় শাসনের বদলে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র। বহু সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিবিধ চিন্তার স্বাধীনতার পাশাপাশি স্বীকার করা হচ্ছে বাজার অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি মালিকানা, সমবায়, আধা সরকারি, এমনকী ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রাসঙ্গিকতাও মেনে নিচ্ছে সিপিএম।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নে এক নয়া অর্থনৈতিক নীতি (যাকে আমরা ‘নেপ’ বলি) চালু করেছিলেন। সেই নীতিতে সমবায় ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির পাশাপাশি নানা ধরনের বেসরকারি অথর্নীতির পরিসর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে অনেক ভাল হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে অনেক ভুলচুকও হয়েছে। মার্কসবাদ কোনও স্থিতিশীল ধারণা নয়। সেই ভুলচুকগুলিকে স্বীকার করে নিয়েই মার্কসবাদীদের এগোতে হয়। যেমন ভারতীয় সমাজে আজ বাজার এবং পুঁজিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যাচ্ছে না। কাজেই তার মধ্য থেকেই আমাদের বিকল্প সমাজতান্ত্রিক মডেলটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”
এ বারের দলিলে আর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সিপিএমের ভারতীয় চরিত্রকে বিশেষ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা। প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরে চিন, এই দুই দেশের সমাজতান্ত্রিক মডেল নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিতর্ক আজ ইতিহাস। ১৯৬৪ সালে সিপিআইয়ের বিভাজনের পিছনেও বড় কারণ, চিন এবং রুশ মডেল নিয়ে বিতর্ক। আর এখন লাতিন আমেরিকার দেশগুলি যে ভাবে বাজার অর্থনীতিকে মেনে নিয়েও আন্দোলনের মাধ্যমে বিকল্প তৈরি করছে, তাতে সিপিএমের শীর্ষ নেতারা অত্যন্ত আকৃষ্ট। কিন্তু তাই বলে অতীতের পথ ধরে লাতিন আমেরিকার মডেলকে অন্ধের মতো অনুকরণ করতে তাঁরা রাজি নন। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে, ভারতীয় মানসিকতার মধ্য দিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপরেই এখন জোর দিচ্ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন, বিমান বসু থেকে শুরু করে প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরিরা।
বুদ্ধবাবু বলেন, “জাতীয় স্তরে কংগ্রেস এবং বিজেপি-র বিকল্প জোট তুলে ধরতে গেলে শুধু আঞ্চলিক দলগুলির জোট গঠন না-করে আপাতত সিপিএমের উচিত আর্থিক ও সামাজিক নীতিগুলি আরও বেশি করে প্রচার করা। যাতে আরও বেশি মানুষ সেই নীতি ও মতাদর্শে আকৃষ্ট হতে পারেন।” তাতে চলার পথ আরও দীর্ঘ হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধবাবুরা মনে করছেন সেটিই সঠিক পথ। অন্য দলগুলির মতো সস্তায় জাতপাত ও ধর্মকে রাজনৈতিক মূলধন করে বাজিমাত করতে তাঁরা খুব একটা আগ্রহী নন। নিরুপমবাবু বলেন, “আসলে লেনিন ধীরে ধীরে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে বিকশিত করার পথে এগোচ্ছিলেন। তাঁর অর্থনৈতিক চিন্তাগুলিও বাস্তববাদী ছিল। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যু সেই সময় সমস্যা সৃষ্টি করে।”
চিনেও প্রথম দিকে যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল, তাতে সমস্যা বাড়ছে বুঝে দেশের শীর্ষ নেতারা পথ বদলে নিয়েছিলেন। বুদ্ধবাবু বলেন, “সেই সময় আমি নিজে চিনে গিয়ে দেখেছি, জুতো ছিঁড়ে গেলেও সেটি সারাতে কারখানায় যেতে হয়। আশেপাশে কোনও দোকান নেই। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতির পরিচালনা যে সম্ভব নয়, সেটি বুঝতে পেরে চিন সময়ের হাত ধরে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। সিপিএম-ও ভারতের পরিস্থিতি অনুসারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতেই এগোচ্ছে।”
সিপিএম নেতাদের মতে, মার্কসবাদ সব সময়ই পরিবর্তনকে বাস্তবতা বলে মেনে নেয়। এবং এখন মাকর্সবাদের ‘ব্যবহারিক প্রয়োগ’-এর ক্ষেত্রে শুধু নয়, ‘তাত্ত্বিক ভিত্তি’তেও এই পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তাঁদের অনেকেই। ইতিহাসবিদ দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি বলেছিলেন, “মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। কারণ, এটির ব্যবহারিক প্রয়োগ করা যায়।” আজ সিপিএম নেতারা এই তত্ত্বকে বাস্তবে কাজে লাগানোর জন্য অনেকটাই পরিবর্তন করার কথা ভাবছেন।
তবে প্রশ্ন অনেক থেকেই যায়। জাঁ পল সাত্রে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক সংস্কারের নমুনা (১৯৬৮-র প্রাগ বসন্ত) দেখে তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যান। তার পর তিনি মাও জে দং-এর চিন্তাভাবনাকে সমর্থন করতে শুরু করেন। কিন্তু পরে সেই মতাদর্শ নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন সাত্রে। ট্রটস্কি থেকে গ্রামশি-র মতো নেতারাও এই প্রশ্নগুলি তুলেছিলেন। কিন্তু তখন স্তালিনীয় নীতিকে অন্ধ ভাবে অনুসরণ করেছিলেন ভারতের কমিউনিস্টরা। ক্রুশ্চেভ স্তালিনীয় নীতির যে সংস্কারের কথা বলেছিলেন, আর আজ যে অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা সিপিএম বলছে, তার সাদৃশ্য নিয়েও দলের মধ্যে তাত্ত্বিক প্রশ্ন আছে। সিপিএমেরই এক নেতার মন্তব্য, “গ্রামশি-ট্রটস্কি থেকে সাত্রে যেটা আগে বুঝেছিলেন, সেটি বোধহয় এত বছর পরে আমরা বুঝছি। বেটার লেট দ্যান নেভার।”
সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, যদি শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্রই না-থাকে, একদলীয় শাসনের বদলে যদি ‘বুর্জোয়া’ গণতন্ত্রের বহুদলীয় ব্যবস্থাকেই মেনে নেওয়া হয়, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বদলে যদি বাজার এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত দু’ধরনের অর্থনীতির কথা বলা হয়, তবে তার সঙ্গে মিশ্র অর্থনীতি এবং স্যোশাল ডেমোক্র্যাটদের চিন্তাভাবনার তফাতটা কী থাকে? এই প্রশ্নগুলিরই জবাব এ বার পার্টি কংগ্রেসে দিতে চাইবেন কারাট-বিমানরা।
রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত দলিলে যা-ই বলা হোক, সিপিএমের দলীয় গঠনতন্ত্রে কিন্তু এখনও লেখা আছে যে, কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য হচ্ছে বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। পার্টি কংগ্রেসে নতুন দলিল অনুমোদিত হওয়ার পর তবে কি পার্টি তার গঠনতন্ত্রের এই অনুচ্ছেদেও ‘পরিবর্তন’ আনবে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.