অবরুদ্ধ পথে ভোগান্তি অব্যাহত • বাসেও হামলা • ৮ই বৈঠক ডাকলেন মদন |
|
শক্তি বাড়িয়ে অটো-নৈরাজ্য বহাল শহরে
নিজস্ব সংবাদদাতা |
|
সপ্তাহের দ্বিতীয় কাজের দিনে ‘পরাক্রম’ আরও বাড়িয়ে শহর-শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকা অবরুদ্ধ করে রাখলেন অটোচালকেরা। ফলে নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদেরও দুর্ভোগের অন্ত রইল না।
অটোর জ্বালানি গ্যাসের দাম কমানো এবং ‘পুলিশি জুলুমের’ প্রতিবাদে সোমবারই পথে নেমেছিলেন অটোচালকেরা। সরকারের আর্জি ছিল, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন স্থগিত রাখুন। কিন্তু সে আবেদনে সাড়া তো মেলেইনি, উপরন্তু মঙ্গলবারের অবরোধ-বিক্ষোভে সামিল হন আরও বেশি সংখ্যক অটোচালক। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ দিন মহাকরণে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ছিলেন তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী দোলা সেন-সহ দলের অটোরিকশা সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বও। বৈঠকে স্থির হয়েছে, বিভিন্ন রুটের অটোচালকদের প্রতিনিধি ও পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে ৮ এপ্রিল পরিবহণমন্ত্রী আলোচনায় বসবেন। তার পরে সরকার যথোচিত সিদ্ধান্ত নেবে। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে দোলাদেবী অবশ্য পুরো ঘটনার পিছনে সিপিএমের ‘ষড়যন্ত্র’কেই দায়ী করছেন।
কিন্তু অটোচালকেরা শহর জুড়ে দিনভর ‘তাণ্ডব’ চালিয়ে গেলেও পুলিশ কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশকর্তাদের কী বক্তব্য?
অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে কলকাতা পুলিশের ডিসি (ইএসডি) সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পুলিশ বেলা সাড়ে দশটার মধ্যে কাঁকুড়গাছি ও উল্টোডাঙার হাডকো মোড়ে অবরোধ তোলে। কাঁকুড়গাছিতে ১৮ জন ও উল্টোডাঙায় ১০ জনকে গ্রেফতার করেছি।” লালবাজার-সূত্রের খবর, সব মিলিয়ে ২৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশ কেন পুরোপুরি ‘সক্রিয়’ হয়নি, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মদনবাবু বলেন, “তখন রাস্তায় প্রচুর অফিসযাত্রী ও স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছিলেন। লাঠি চালিয়ে অবরোধ তুলতে গেলে অনেক নিরীহ লোক জখম হতেন। তাই পুলিশকে খানিকটা সংযত থাকতে হয়েছে।” তবে শাসকদলের বিধায়ক পরেশ পাল সক্রিয় ছিলেন। কাঁকুড়গাছিতে অটোচালকদের অবরোধ তুলতে তিনি এ দিন পথে নামেন। এমনকী, অবরোধ না-তোলায় এক অটোচালককে চড়ও মারেন। বেহালাতেও স্থানীয় এক তৃণমূল কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে এক অটোচালককে চড় মারার অভিযোগ উঠেছে।
মহাকরণ-সূত্রের খবর: অটো-পরিস্থিতি সামাল দিতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা ও পরিবহণমন্ত্রীকে ডেকে এ দিন তা জানতে চেয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ, পরিবহণ ও অটো ইউনিয়নের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক সেরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে গিয়ে এ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন মদনবাবু ও পার্থবাবু। তার পরেই পার্থবাবু জানিয়ে দেন, আগামী ৮ তারিখে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে অটোচালকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজ্য সরকার বৈঠকে বসবে।
অটো ইউনিয়ন-সূত্রের খবর: মাসখানেকের মধ্যে জ্বালানি গ্যাসের দাম প্রায় দশ টাকা বেড়ে লিটারপিছু ৫৩ টাকা ৬ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। যার প্রতিবাদে অটোচালকেরা সোমবার থেকে অবরোধ-আন্দোলনে নেমেছেন। একই সঙ্গে তাঁদের একাংশের অভিযোগ, সম্প্রতি কলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় ‘পুলিশি জুলুম’ বেড়ে গিয়েছে। এ দিন পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে দোলাদেবীও বলেন, গত দেড় মাসে গ্যাসের দাম লিটারে সাড়ে দশ টাকা বেড়েছে বলে অটোচালকেরা তাঁকে জানিয়েছেন। তা হলে সরকার অটো ভাড়া বাড়াচ্ছে না কেন?
এই পরিস্থিতিতেও অটোভাড়া বাড়ানোর কথা যে তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকার এখনই ভাবছে না, দলের শ্রমিকনেত্রী দোলাদেবী তা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। তবে তিনি এ-ও বলছেন, “একটা সমাধান হওয়া অবশ্যই দরকার। ৮ এপ্রিল সকালে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি ও দুই ২৪ পরগনার প্রতি রুটের অন্তত দু’জন অটোচালককে নিয়ে বৈঠক করবেন পরিবহণমন্ত্রী। আশা করা যায়, সেখানে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র বেরোবে।”
উল্লেখ্য, অটোর ভাড়া ইউনিয়নগুলোই ঠিক করে, সেখানে সরকারের ভূমিকা নেই। কিন্তু ঘটনা হল, পালাবদলের পরে অধিকাংশ অটো ইউনিয়ন তৃণমূলের কব্জায় চলে যাওয়ায় দলের ভাড়া না-বাড়ানোর নীতিই সেখানে কার্যকর হচ্ছে।
এবং দাবি মেটার আশু ইঙ্গিত না-পেয়ে জোরদার হচ্ছে আন্দোলন। কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের খবর: এ দিন বেলা দশটা নাগাদ উল্টোডাঙা, মানিকতলা, তারাতলা, রুবি মোড়, জোড়াবাগান, কাঁকুড়গাছি, ফুলবাগান, বেলেঘাটা, বি কে পাল অ্যাভিনিউ, বেহালা, পাতিপুকুর, দক্ষিণদাঁড়িতে দফায় দফায় অবরোধে নামেন অটোচালকেরা। ব্যস্ত অফিসটাইমে রাস্তায় রাস্তায় যানবাহন জট পাকিয়ে যায়। ইএম বাইপাসের সঙ্গে বেলেঘাটা-কাঁকুড়গাছি-ফুলবাগানের যোগাযোগ বহু ক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। অনেক জায়গায় বাস-মিনিবাস থেকে জবরদস্তি যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া, এমনকী স্কুল-গাড়িতেও ইট-পাথর ছোড়ার অভিযোগ এসেছে। পুলিশ কয়েকটি রুটের বাস অন্য পথে ঘুরিয়ে দিতে গেলে অটোচালকদের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন জোকা-তারাতলা, তারাতলা-গড়িয়াহাট, উল্টোডাঙা-শোভাবাজার, কাঁকুড়গাছি-করুণাময়ী, গড়িয়াহাট-রুবি, তারাতলা-বেহালা, গিরিশ পার্ক-মানিকতলা রুটে অটো চলাচল দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকায় নিত্যযাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন। সল্টলেকের পিএনবি এবং করুণাময়ীতে অবরোধের ফলে বেশ কিছুক্ষণ ওই তল্লাটে যানজট হয়। পুলিশ দ্রুত ওখানে গিয়ে অবরোধ ওঠায়। উল্টোডাঙা, কাঁকুড়গাছি, ফুলবাগান-বেলেঘাটায় অটোচালকদের অবরোধের জেরে সল্টলেকের অফিসযাত্রীরা, বিশেষত পাঁচ নম্বর সেক্টরে আইটি কর্মীরাও চরম দুর্ভোগে পড়েন। দোলাদেবীর অবশ্য দাবি, “কলকাতার অধিকাংশ রুটে এ দিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। কিছু রুটে অবশ্যই সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। যা খুবই নিন্দনীয় ও লজ্জাজনক।”
আমজনতার এই ভোগান্তির জন্য সিপিএমের দিকেই আঙুল তুলছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের শ্রমিকনেত্রী দোলাদেবীর কথায়, “আমরা যা খবর পেয়েছি, এই বিশৃঙ্খলা তৈরির পিছনে কোথাও সিপিএম প্রত্যক্ষ ভাবে, কোথাও বা কংগ্রেস পরোক্ষে মদত দিয়েছে।” শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবুও এ প্রসঙ্গে সিপিএম-কে দায়ী করে বলেন, “সিপিএমের মদতে পুষ্ট গুন্ডারা অরাজক অবস্থা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার কিছুতেই এ সব বরদাস্ত করবে না। আইন আইনের পথেই চলবে।”
কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে তো শহর-শহরতলির প্রায় সর্বত্র অটো ইউনিয়নের লাগাম সিটু-র হাতছাড়া! তা হলে সিপিএম কী ভাবে অবরোধ সংগঠিত করল?
কোনও জবাব না-দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে বেরিয়ে যান শিল্পমন্ত্রী। সিটু’র রাজ্য সভাপতি শ্যমল চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, “প্রতিবাদের মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই। এখানে কোনও ঝান্ডারও প্রশ্ন নেই। গ্যাসের দাম সিপিএম বাড়ায়নি, বাড়িয়েছে তৃণমূল ও কংগ্রেসের সরকার। তবে ভাঙচুরের ঘটনা নিন্দনীয়।”
সিটু নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “অবরোধকে অন্যায় বলছি না। তবে তৃণমূলের ঝান্ডাধারী ইউনিয়নই এ সব করেছে। ওদের বুঝিয়ে বলা যেত। তা না-করে মারধর করা হল।” সিটু-সমর্থকদের পেট্রোল পাম্প ইতাদিতে বিক্ষোভ দেখিয়ে প্রতিবাদ করতে বলা হয়েছে বলেও জানান সুভাষবাবু।
|
নেপথ্যের নানা তথ্য |
অটোচালকেরা আন্দোলনে কেন?
জ্বালানি গ্যাসের দাম কমানোর দাবিতে। আছে বাড়তি যাত্রী তোলার দাবিও।
গ্যাসের দাম এখন কত?
প্রতি লিটার ৫৩ টাকা ৬ পয়সা।
এক বছরে কত বেড়েছে?
৪১%।
দাম এতটা বাড়ল কেন?
রান্নার গ্যাস-ডিজেল-কেরোসিনের মতো কোনও ভর্তুকি গাড়ির গ্যাসে নেই।
অটোচালকদের কি ছাড় দেওয়া যেত না?
ভর্তুকি দেওয়া যেত। কিন্তু ভর্তুকির টাকাটা তো আমজনতার পকেট থেকেই আসবে!
সরকার কেন অটোর ভাড়া বাড়াচ্ছে না?
অটোভাড়া ঠিক করে ইউনিয়নগুলি। রাজ্যের ভূমিকা নেই।
অটোর রুট (যাত্রাপথ) স্থির করে কারা?
রুটও বেঁধে দেয় ইউনিয়ন। আরটিও-র অনুমোদন লাগে।
তা হলে চালকেরা কেন ইউনিয়নের কাছে ভাড়া বাড়ানোর দাবি করছেন না?
শহর-শহরতলির প্রায় সব ইউনিয়ন এখন তৃণমূলের দখলে। তারা জানিয়ে দিয়েছে, দলীয় নীতি মেনে ভাড়া বাড়ানো যাবে না।
অটোয় কত যাত্রী উঠবে, তার কোনও নিয়ম রয়েছে?
মোটর ভেহিক্লস আইন মোতাবেক তিন জন যাত্রী নেওয়া যায়। চার জন নিতেও বাধা নেই। এর বেশি হলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
রাজ্য পরিবহণ দফতর অটোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না কেন?
পরিযান আইন বলছে, ট্যাক্সির মতো অটোও চলবে মিটারে। কিন্তু এ রাজ্যে তার চল নেই। অর্থাৎ, এখানে অটো আইন ভেঙেই চলে।
মহানগরে মোট কত রুটে অটো চলে?
কলকাতা ও শহরতলি মিলিয়ে প্রায় ৩২৫ রুটে।
মহানগরে অটোর সংখ্যা কত?
সরকারি হিসেব নেই। বেসরকারি হিসেবে, অন্তত ৭০ হাজার। |
|