আইনরক্ষকেরা অসহায় এবং নাজেহাল। ঘোর দুর্বিপাকে আইনরক্ষকদের উপর নির্ভরশীল হাজার-হাজার নিত্যযাত্রী। শেষ পর্যন্ত আইন হাতে তুললেন আইনসভার সদস্য। বিরোধীদলে থাকার সময় একদা ‘হল্লা-ব্রিগেডে’র প্রথমসারিতে থাকতেন তিনি। গরু-ছাগল নিয়ে ধর্মতলার মোড় অবরুদ্ধ করে দেওয়া বা ইটপাটকেল ছুড়ে ‘অপছন্দে’র ইমারত ভাঙচুর করা তাঁর এবং তাঁর বাহিনীর কাছে জলভাত ছিল। ইদানীং অবশ্য খানিকটা ‘নিষ্প্রভ’ হয়ে পড়েছিলেন। তার একটা বড় কারণ তাঁর নেত্রীর ‘ভাবমূর্তি’ বদলের মরিয়া চেষ্টা এবং দ্বিতীয়ত সামগ্রিক ভাবে ‘ভাঙচুরের রাজনীতি’র পিছনের সারিতে চলে-যাওয়া।
মঙ্গলবার কলকাতার রাস্তায় আবার ‘স্বমহিমায়’ পরেশ পাল। যিনি কাঁকুড়গাছির মোড়ে সপাটে চড়িয়েছেন মারমুখী অটোচালকদের একাংশকে। কাউকে কাউকে সর্বসমক্ষে কান ধরে ওঠবোসও করিয়েছেন।
এবং ঘটনার অব্যবহিত পরে সটান বলেছেন, “আমি মনে করি, এই কাজটা করা উচিত ছিল। না-হলে ওই অরাজকতাটা চলতেই থাকত! বাচ্চাদের বাস থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। বাসে ইট মারছে! দাবিদাওয়া বা ক্ষোভ থাকতেই পারে। সকলেরই থাকে। কিন্তু এ ভাবে কি আন্দোলন হয়? নাকি আন্দোলন করা যায়?”
ক্রোধ খানিকটা প্রশমিত হওয়ার পর অবশ্য তাঁর বক্তব্য, “বিবেকের তাড়নায় করে ফেলেছি। তখন ওই তল্লাটে পুলিশ দেখিনি। ঠিক চড় মারিনি। আমার গাড়ির কাছে ওদের দেখে আমি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই। আর আমি নই, আমার পাশ থেকে কেউ ওদের ওঠবোস করাচ্ছিল।” |
‘দাওয়াই’ |
|
|
এক অটোচালককে ওঠবোসের ‘আদেশ’। অন্য জনকে সপাটে চড়।
মঙ্গলবার সকালে কাঁকুড়গাছি মোড়ে বিধায়ক পরেশ পাল। নিজস্ব চিত্র |
|
প্রকাশ্যে না-বললেও তৃণমূল বিধায়কের ভয়, ওই ভাবে অটোচালকদের মহড়া নেওয়ায় না ‘দিদি’ কুপিত হন!
তবে অটোচালকদের জন্য পরেশবাবুর ‘দাওয়াই’য়ের ছবি নিউজ চ্যানেলে দেখানো শুরু হতেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে তাঁর সমর্থনে মন্তব্যের ঝড় উঠেছে। সোম এবং মঙ্গলবার অটোচালকদের আন্দোলনে ভুক্তভোগীদের একটি বড় অংশ পরেশবাবুকে সমর্থনই করেছেন। তাঁর বিপক্ষেও মন্তব্য রয়েছে অবশ্য। যাঁরা বলেছেন, ওই ভাবে একজন বিধায়কের আইন হাতে তুলে নেওয়া উচিত হয়নি। সাইটে সিপিএমের নেতৃস্থানীয়রা এর মধ্যে ‘একনায়কতন্ত্রে’র সঙ্কেতও দেখতে পাচ্ছেন। বস্তুত, বিধানসভায় পরেশবাবুর অগ্রজ সহকর্মী এবং রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও বলেছেন, ওই ভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া অনুচিত হয়েছে। আবার পরিবহন মন্ত্রী মদন মিত্র বলেছেন, “এলাকায় গোলমাল হলে এলাকার বিধায়ক তো রাস্তায় নামবেনই! এতে অন্যায় কী আছে?” কাজের দিনে বেরিয়ে অটোচালকদের অবরোধে যাঁরা কাঁকুড়গাছির মোড়ে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন, তাঁদের বৃহদংশও শাসকদলের বিধায়কের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা এমনও জানাচ্ছেন যে, অটোচালকদের ‘শায়েস্তা’ করতে রাস্তায় নেমে রং দেখেননি এলাকার জনপ্রতিনিধি। ওই সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত করুণাময়ী-কাঁকুড়গাছি রুটের অটোচালক বিকাশ রজকেরও বক্তব্য, তাঁদের রুটের তৃণমূল ইউনিয়নের সেক্রেটারি অবনী চন্দ্র থেকে শুরু করে বাবুসোনা, দুলু প্রমুখ অটোচালকেরা বিধায়কের হাতে চড়-থাপ্পড় খেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট অটোচালকেরা কোন ইউনিয়ন করেন, তা নিয়ে সরাসরি মন্তব্য না-করলেও পরেশবাবু বলেন, “বাম-জমানায় এরা সিপিএমের সঙ্গে ছিল। এখন আমাদের বদনাম করছে।”
তার আগে শহরবাসী নিউজ চ্যানেলে দেখেছেন ট্রামরাস্তা ধরে পুলিশ দৌড়োচ্ছে আর তাদের চোখের সামনেই আধলা ইট ছোড়া হচ্ছে বাসের উইন্ডস্ক্রিনে। এক নয়, একাধিক যুবক বাস ভাঙচুর করতে চাইছে। এলাকায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। দিশেহারা হয়ে পালাচ্ছেন মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে অফিসযাত্রীরা। রাস্তায় নেমে এসেছে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। যা দেখা যায়নি, ওই হিংসাত্মক অবরোধ-ভাঙচুরের জেরে কার্যত গোটা পূর্ব কলকাতা থমকে গিয়েছে ততক্ষণে।
নিউজ চ্যানেলে তার পরেই দেখা গিয়েছে পরেশবাবুকে। আদি-অকৃত্রিম সাদা সুতির শার্টের বিধায়ককে দেখা গিয়েছে একজন যুবককে সপাটে চড়াচ্ছেন। অন্য একজনকে উত্তেজিত ভাবে আঙুল তুলে কিছু বোঝাচ্ছেন এবং কালক্রমে সে বারদুয়েক পরেশবাবুর সামনে কান ধরে ওঠবোস করছে। দৃশ্যান্তরে এক যুবককে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যানের চাকার গায়ে ঠেসে বেধড়ক মারধর করছে কয়েকজন যুবক। আরও একটি দৃশ্যে এক একলা যুবককে উপর্যূপরি আঘাত করছে আরও এক যুবক।
অভিযোগ, মারধরকারীরা সকলেই ‘পরেশ-বাহিনী’র সদস্য। তাদের উত্তেজিত হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষত, যখন তাদের নেতা বলছেন, “নিজের চোখে দেখছিলাম, স্কুলবাস থেকে বাচ্চাদের নামানো হচ্ছে। বাসে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের উপরে ওরা জুলুম করছে। ও সব দেখে চুপ থাকা যায়! আমি ওদের বলি, তোমাদের পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। তাতে অটো ইউনিয়নের পান্ডারা বলে, আপনাকে দালালি করতে হবে না। এটা সহ্য করা যায় না!” তাঁর আরও দাবি, “এরা সব সিপিএমের লোক। পরিকল্পনা করে আমাদের প্রশাসনকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। আমি ওদের সাফ বলে দিয়েছি, গোলমাল করতে হলে যেন সিপিএমের ঝান্ডা হাতে নিয়ে করে!”
স্থানীয় অটোচালকদের বক্তব্য অবশ্য অটোর তৃণমূল ইউনিয়নের কর্মীদের দিকেই আঙুল তুলছে। কাঁকুড়গাছি-করুণাময়ী রুটের জনৈক অটোচালক বিকাশবাবুর দাবি, তিনি ও তাঁদের ইউনিয়নের মাথারা সকলেই তৃণমূল করেন। তাঁর কথায়, “আমরা পরেশবাবুর পার্টিই করি। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, পুলিশি জুলুম নানা সমস্যায় আমরা জেরবার। বাসগুলোকে ধরে ধরে বলছিলাম, ওরা কেন এত বাড়তি লোক নিয়ে যাচ্ছে! ভাবিনি পরেশবাবু এসে আমাদেরই মারধর করবেন। আমাদের সেক্রেটারি অবনী চন্দ্র মার খেয়ে আহত হয়ে বাড়িই চলে গিয়েছেন।”
এখন দেখার, তৃণমূলের ইউনিয়ন পরেশবাবুর বিরুদ্ধে রাজ্যনেতৃত্বের কাছে নালিশ করে কিনা। দেখার, সেই অভিযোগে কতটা গুরুত্ব দেন তাঁর দলনেত্রী। |