রেল লাইন পার হইতে গিয়া ট্রেনে কাটা পড়িয়া মৃত্যুর ঘটনা ক্রমশই বাড়িতেছে। এ ধরনের অপঘাত-মৃত্যুর জন্য সচরাচর যানবাহনের উপরেই দোষারোপ করার রেওয়াজ চালু আছে। চলন্ত ট্রেন হউক কিংবা ধাবমান মোটরযান, চালক কেন দেখিয়া-শুনিয়া গাড়ি চালান নাই, লোক পারাপার হইতেছে দেখিয়াও ব্রেক কষিয়া গাড়ি দাঁড় করান নাই, এমন অভিযোগ কিংবা ক্ষোভই সাধারণত শুনা যায়। দ্রুতবেগে গাড়ি আসিতেছে দেখিয়াও যিনি ছুটিয়া রাস্তা পার হন কিংবা ট্রেন পৌঁছাইবার আগেই লাইনের অন্য পারে চলিয়া যাইবেন ভাবিয়া যিনি ঝুঁকি লইয়া রেলপথ ধরিয়া হাঁটেন, তাঁহাকে কেহ দোষ দেয় না। অথচ দোষ এ সব ক্ষেত্রে তাঁহারই। কোনও দ্রুতগামী ট্রেনের পক্ষেই স্বল্প দূরত্বের মধ্যে ব্রেক কষিয়া গাড়ি থামানো সম্ভব নয়। সাঁতরাগাছি স্টেশনে শনিবার পাঁচ জন যাত্রীর জীবনের বিনিময়ে এই সত্যটি নূতন করিয়া প্রতিষ্ঠিত হইল।
সাঁতরাগাছি স্টেশনে কিন্তু লাইন পারাপারের জন্য উড়াল পুল ছিল। কিন্তু তাহাতে চড়িয়া অন্য পারে যাইতে সময় লাগে। সেই সময়টুকু বাঁচাইতেই ছেলেমেয়ে লইয়া লাইনে নামিয়া পড়া। একই ভাবে সময় বাঁচাইবার জন্য প্রাণের ঝুঁকি লইয়া পথচারীরা সড়ক পারাপারও করিয়া থাকেন। সামান্য একটু সময় বাঁচাইতে গিয়া জীবনই বাঁচে না। অনেকে আবার পথ চলার ব্যাপারে এত উদাসীন যে কানে মোবাইল সাঁটিয়া অপর প্রান্তের সহিত আলাপচারিতায় মগ্ন অবস্থায় রেল বা সড়ক পথ পার হইতে গিয়া কাটা পড়েন। রেলপথে কাটা পড়ার ক্ষেত্রে কখনও কখনও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং দিয়া আড়াআড়ি ভাবে যাত্রিবোঝাই গাড়ির পার হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ ক্ষেত্রেও লেভেল ক্রসিং কেন অরক্ষিত থাকে, কেন সেখানে পাহারাদার থাকে না, এই সব প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু যিনি বা যাঁহারা গাড়ি লইয়া পার হইতেছেন, নিজেদের প্রাণ রক্ষার দায় তো প্রথমত তাঁহাদের নিজেদেরই, তাঁহারা কেন দেখিয়া-শুনিয়া পার হইবেন না? নিজ প্রাণের দায়িত্ব কেন ধাবমান দ্রুতগামী গাড়ির চালকের হস্তে ন্যস্ত করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিবেন? তাঁহাদের কি নিজেদের প্রাণের প্রতি বিন্দুমাত্র মায়াও নাই? যদি তাহা না থাকে, তবে গাড়ি-চালকের থাকিবে, ইহাই বা ধরিয়া লওয়া কেন?
আসলে এ ধরনের বেপরোয়া জীবনযাপনে জনসাধারণ অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছেন। পথ চলার যে-সব নিয়মকানুন আছে, পদে পদে তাহা লঙ্ঘন করাতেই যেন পথিকের বা যান-চালকেরও আনন্দ। দ্বিচক্রযানের চালক ও আরোহীদের ক্ষেত্রে যেমন হেলমেট পরিধান অপরিহার্য এবং না-পরাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধও। কিন্তু শহর বা শহরতলিতে কয় জন সেই নিয়ম পালন করিতেছে? প্রায়শই দেখা যায়, চালক হেলমেট পরিলেও পিছনের সিটে বসা সঙ্গিনীর মাথা শিরস্ত্রাণহীন, কোলের শিশুটির তো প্রশ্নই নাই। পুলিশ নিয়মিত নিষেধ করিতেছে, কড়াকড়িও। পত্রপত্রিকায়, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে নিত্য সতর্কতাসূচক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হইতেছে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মাইকে সর্বক্ষণ লাইনে নামিতে নিষেধ করিয়া উড়াল পুল ব্যবহার করিতে অনুরোধ করা হইতেছে। কিন্তু সে সবে কেহ কর্ণপাত করে না। পথের আইন লঙ্ঘন করা, ঝুঁকি লইয়া বেপরোয়া পারাপারই যেন দস্তুর। হাঁটার জন্য পুরসভা পৃথক উড়াল পথ বানাইয়া দিলেও লোকে তাহা ব্যবহার করে না, তাহার নীচ দিয়াই জল-কাদা-জঞ্জাল মাড়াইয়া গুঁতোগুঁতি করিয়া গন্তব্যে পৌঁছাইতে চাহে। যেন পথে বাহির হইলেই মানুষকে ঝুঁকি লওয়ার উদগ্র বাসনা পাইয়া বসে। ইহার পরিণতি সর্বদাই মর্মান্তিক। বহু অকালমৃত্যু এই অকারণ ঝুঁকি লওয়ার পরিণাম। কিন্তু যে মরিবে মনস্থ করিয়াই পথে বাহির হয়, তাহাকে বাঁচাইবে কে? রেলমন্ত্রী নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করিতেই পারেন, পরিবহণমন্ত্রীও পারেন পথ-দুর্ঘটনার বলি মানুষদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দিতে। কিন্তু তাহাতে ঝুঁকি লইয়া পথ চলার প্রবণতা বিন্দুমাত্র প্রশমিত বা সংশোধিত হয় না। |