ছয় শত চৌষট্টিটি আসনের ভিতর মাত্র পঁয়তাল্লিশ। সংখ্যার বিচারে আণুবীক্ষণিক না হইলেও, মনে হইতে পারে, কার্যত তাৎপর্যহীন। বাস্তব অন্য কথা বলিবে। মায়ানমারের বাস্তব। সেই দেশের অবিসংবাদিত জননেত্রী সু চি-র বাস্তব। ১৯৯০-এর নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ, এবং তাহার পরে ফৌজিশাহির হস্তে গণতন্ত্রের আমূল কণ্ঠরোধ তিনি দেখিয়াছেন। গৃহবন্দি থাকিয়াছেন অর্ধ দশকেরও অধিক সময়কাল। অতঃপর, সু চি যদি নির্বাচনে জিতিয়া পার্লামেন্ট-এ প্রবেশ করেন, তাহা একটি মাইলফলক হিসাবে পরিগণিত হইবে। মায়ানমারের ইতিহাসে। বিশ্বের গণতন্ত্রের ইতিহাসেও। আইনসভায় ছেষট্টি বৎসরের নেত্রীর জন-নির্বাচিত উপস্থিতি ঠিক কী বুঝাইবে? তাঁহার ব্যক্তিগত কোনও জয়? সত্য। কিন্তু, শেষ সত্য নহে। সু চি-র পক্ষে নিশ্চিত ভাবেই ইহা একটি মধুর পট পরিবর্তন। কিন্তু, নিছকই এমন ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণে বদ্ধ থাকিলে বৃহত্তর প্রেক্ষিতটি হারাইয়া যাইতে পারে। বৃহত্তর প্রেক্ষিতটির নাম গণতন্ত্র। সেই অর্থে ইহা গণতন্ত্রেরই জয়। শেষ পর্যন্ত সু চি-র দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি’ (এন এল ডি) যে কয়টি আসনই পাক না কেন, তাহা একটি গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করিবে। তাই, ছয় শত চৌষট্টিটি আসনের এক দশমাংশেরও কম আসনে এই নির্বাচন সারা বিশ্বের নজর কাড়িয়াছে।
বিশেষত, ভারতের। নয়াদিল্লির মায়ানমার নীতি, সাম্প্রতিক কালে, কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়বাহী ছিল। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ, সুতরাং সু চি-র গণতন্ত্রকামী আন্দোলনে তাহার সমর্থন থাকিবে, ইহাই প্রত্যাশিত। সমর্থন ছিলও। অথচ সেই কারণে মায়ানমারের ফৌজিশাহিকে নয়াদিল্লি জল-অচল করিয়া রাখিতে চাহে নাই। সু চি-র প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি সত্ত্বেও ভারত মায়ানমারের ফৌজিশাহির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নাই। কেন করে নাই, তাহার প্রত্যক্ষ এবং প্রধান কারণ চিন। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে শঙ্কিত ভারত খেয়াল করিয়াছিল, মায়ানমারকে ব্রাত্য করিয়া রাখিলে চিন আরও বেশি করিয়া স্বীয় প্রভাব খাটাইবার সুযোগ পাইবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বেজিং-এর প্রতিপত্তি এখনই যথেষ্ট। তাহা আরও বাড়িবে, এই বিবেচনায় নয়াদিল্লি মায়ানমার-নীতিকে চূড়ান্ত আদর্শায়িত কোনও পরিসরে রাখে নাই। গণতন্ত্র অবরুদ্ধ, ফলে মুখদর্শন করিব না, এমন কোনও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নাই। সেই নীতির ভিতর আদর্শের পাশাপাশি কূটনৈতিক বাস্তববোধও ছিল।
তাহার পরে মায়ানমারেও পট বদলাইয়াছে ঢের। এই মুহূর্তে সেই দেশে আধা-ফৌজি আধা-প্রজাতান্ত্রিক একটি সরকার বিদ্যমান। সু চি-কে নির্বাচনে দাঁড়াইতে দিবার সিদ্ধান্তই প্রমাণ, প্রশাসন গণতন্ত্রের উত্থানকে পূর্বের ন্যায় যে কোনও মূল্যে রোধ করিতে চাহে না। সেই অর্থে ইহা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রেরই জয়। নির্বাচনে জয়লাভ করিলে পার্লামেন্ট-এ সু চি-র স্বর আরও বেশি করিয়া স্বদেশ ও বিদেশের গোচরে আসিবে। সেই পরিস্থিতিতে অদূর ভবিষ্যতেই মায়ানমারে গণতান্ত্রিক ভাবধারা একটি বৃহত্তর ভূমিকায় উঠিয়া আসিলে অবাক হইবার কিছু নাই। সেই সূত্রেই ভারতের ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চিন গণতন্ত্রের অনুশীলন করে না। ভারত করে। মায়ানমারে যদি সত্যই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের জয় হয়, তাহা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক চিত্রে ভারতের উপস্থিতিকে আরও তাৎপর্যশীল করিয়া তুলিবে। দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব বলয়েও গণতন্ত্রের এই অভিযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন, তাহা পাকিস্তান নামক দেশটির প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেই সম্যক বুঝা যাইবে। |