ইরান যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। পশ্চিম এশিয়ার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে এই সফর এক অন্য মাত্রা পেতে চলেছে বলে ধারণা কূটনৈতিক শিবিরের।
বছরের শেষ দিকে ইরানের ইস্পাহান শহরে বসছে নির্জোট দেশগুলির ষোড়শ শীর্ষ সম্মেলন। সেই উপলক্ষেই ইরান সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সংশ্লিষ্ট শিবিরের বক্তব্য, ঠান্ডা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নির্জোট সম্মেলনের গুরুত্ব এতটাই কমে গিয়েছে যে সেখানে মনমোহন সিংহের উপস্থিতি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু ওই সফরের আসল উদ্দেশ্য হল ইরানের প্রেসিডেন্ট মেহমুদ আহমেদিনেজাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরান থেকে তেল আমদানি নিয়ে চরম সঙ্কট শুরু হয়েছে ভারতে। সমস্যা হচ্ছে তেলের দাম দেওয়া নিয়েও। অথচ ইরান ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ। তাই ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে সেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করবে নয়াদিল্লি।
তবে মনমোহনের সফরের খবরে নড়ে চড়ে বসেছে আমেরিকা-সহ গোটা পশ্চিমী বিশ্ব। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর ইরান সফরের মাধ্যমে সাউথ ব্লক আসলে তার স্বাধীন বিদেশনীতির বার্তাই দিতে চাইছে। গত সপ্তাহে ৪টি দেশের প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে (চিনের হু জিনতাও, রাশিয়ার দিমিত্রি মেদভেদেভ, ব্রাজিলের ডিলমা রোসেফ, দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাকব জুমা) মনমোহন সিংহ ইরান-প্রশ্নে কার্যত সতর্ক করেছিলেন পশ্চিমী বিশ্বকে। ব্রিকস-এর শীর্ষ সম্মেলনের শেষে সে দিন একযোগে নেতারা বলেছিলেন, ইরান সঙ্কট কাটাতে গণতন্ত্র এবং কূটনীতির রাস্তাটাই নেওয়া শ্রেয়। হিংসার পথে চললে তার পরিণাম মারাত্মক হবে। চিন তো কূটনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেছিল, আমেরিকার ঘরোয়া আইনের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বে তেলের দাম ওঠাপড়া করবে এটা হতে পারে না। আপাতত দিল্লি সতর্কতার সঙ্গে নজর রাখছে পশ্চিম এশিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তার উপর। পশ্চিমের দেশগুলির সঙ্গে ইস্তানবুলে ১৩ এপ্রিল থেকে তেহরানের আলোচনা শুরু হওয়ার কথা।
ইরানের উপর থেকে তেল রফতানির প্রশ্নে নির্ভরতা কমাতে পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশগুলির সঙ্গে জোরদার দৌত্য শুরু করেছে নয়াদিল্লি। চলছে সক্রিয় কূটনৈতিক আদানপ্রদানও। কিন্তু তেহরান থেকে আমদানিকে উপেক্ষা করার মতো কোনও নিশ্চয়তার জায়গা এখনও খুঁজে পায়নি নয়াদিল্লি। বরং আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ফলে ইতিমধ্যেই আমদানিকৃত তেলের দাম মেটানো নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তার সমাধানের পথ খুঁজে দেখা হচ্ছে। গত নভেম্বরে ওয়াশিংটনে জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন ছিল। তখন ইরানের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তেলের দাম মেটানো নিয়ে কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। খাদ্য, ওষুধের মতো পণ্য পাঠিয়ে তেলের দাম মেটানো সম্ভব কিনা তা-ও খতিয়ে দেখছে ভারত। সম্প্রতি গোটা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে বাণিজ্য মন্ত্রকের প্রতিনিধি দলও পাঠিয়েছিল নয়াদিল্লি। ভারত ও ইরান, দু’দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল ২০০৮ সালে। কলম্বো যাওয়ার পথে দিল্লি এসেছিলেন আহমেদিনেজাদ। তখনই তেহরান যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। গত বছর রাষ্ট্রপূঞ্জের সাধারণ অধিবেশনের সময় দেখা হয় দুই নেতার। তখন ২০০৮ সালের সেই আমন্ত্রণের কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট।
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক অটুট রাখার সঙ্গে মনমোহন সরকার কিন্তু মার্কিন প্রভাবমুক্ত এক বিদেশনীতির পথে চলা শুরু করেছে। গত অক্টোবরে রাষ্ট্রপূঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ার গদ্দাফি জমানার বিরুদ্ধে পশ্চিমী প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে ভারত অংশ নেয়নি। তার আগে আমেরিকার লকহিড মার্টিন সংস্থার যুদ্ধবিমান না কেনার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল ভারত। ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়েও কার্যত মার্কিন বিরোধিতাই করে চলেছে নয়াদিল্লি। |