দলের সদর দফতরের বাইরে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে ভিড়। তাঁকে ছুঁতে হাজার হাজার লোকের হুড়োহুড়ি! আর তাঁর বার্তা, “এ বার নতুন যুগের সূচনা হবে।” তত ক্ষণে দেশের সরকারি সংবাদমাধ্যম ঘোষণা করে দিয়েছে, পার্লামেন্টে এই প্রথম বারের জন্য আসন ছিনিয়ে নিয়েছেন সু চি। উপনির্বাচনে তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪০টিই দখল করতে পেরেছে। দেশের নির্বাচন কমিশনও জানিয়ে দিয়েছে, সেনা-নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্টে এ বার বিরোধী আসনে বসার জন্য তৈরি এনএলডি। ৪০টি আসনে জয়ী হয়েছে তারা। তবে দুর্গম এলাকার বাকি ৫টি আসনের ফল রাত পর্যন্ত জানা যায়নি।
মায়ানমারের রাজধানী নেপিদওয়ে ৪টি আসন পেয়েছে এনএলডি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজধানীর ফলই পরিবর্তনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। কারণ নেপিদও শহর গড়ে তুলেছিল সামরিক জুন্টা। এখানে বেশির ভাগ মানুষই পেশায় সরকারি কর্মচারী বা সেনা অফিসার। যাঁদের ভোট শাসক দল ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’র (ইউএসডিপি) পক্ষেই যাওয়া উচিত ছিল। জুন্টা সরকারের হাতে পত্তন এই দলের। কিন্তু সরকারি কর্মীরা যদি এনএলডি-কে জেতানোর জন্য ভোট দিয়ে থাকেন, তা হলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, প্রত্যেকেই এ বার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় দিন গুনছেন। |
সমর্থকদের মুখোমুখি সু চি। দলের সদর দফতরের বাইরে। ছবি: রয়টার্স। |
তবে ইউএসডিপি এই ফলাফল নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও মন্তব্যই করেনি। সু চির অবশ্য আশা, দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে অন্য রাজনৈতিক দলগুলি তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলবে। মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেন সেনের উপদেষ্টা নে জিন লাট সংবাদ সংস্থা এপি-কে বলেছেন, “উপনির্বাচনে সু চি-র দল এত ভোট পাওয়ায় আমি একেবারেই বিস্মিত নই।” সু চি-কে কি ক্যাবিনেট সদস্য করা হবে? যার জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “সব কিছুই হতে পারে। ওঁর যা ক্ষমতা তাতে ওঁকে যে কোনও পদ বা দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।”
গণতন্ত্রকামী এই নেত্রীর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বহু দিনের। সু চি-র জয়ের খবর ঘোষণার মধ্যেই নয়াদিল্লি জানিয়েছে, আগামী মাসে দু’দিনের সফরে মায়ানমারে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতেই এই সফর বলে মনে করা হচ্ছে। মায়ানমারে পরিকাঠামোগত বহু প্রকল্পের সঙ্গে ভারতের সক্রিয় যোগাযোগ রয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সু চি-ও ভারতীয় চ্যানেলকে বলেন, “আবার ভারতে এসে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমার কলেজ লেডি শ্রীরামে যেতে চাই।”
দেশের সেনাপ্রধান থান শোয়ের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া এবং থেন সেনকে দেশের প্রেসিডেন্ট করার মধ্যে দিয়েই ক্রমশ ‘পরিবর্তনে’র দিকে ঝুঁকছিল মায়ানমার। পশ্চিমী দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা তুলতে সেনাবাহিনীর প্রভাব কিছুটা কমিয়ে গণতন্ত্রের পথে পদক্ষেপ করা হচ্ছে ধীরে ধীরে। কারণ, নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ভারত-চিন সীমান্তের এই প্রাকৃতিক সম্পদ-সম্ৃদ্ধ দেশে প্রচুর পশ্চিমী বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর নিষেধাজ্ঞা তোলা হবে কি না, সে ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে পারে এই উপনির্বাচন। বিশেষত উপনির্বাচনটি অবাধ হয়েছে বলে সু চি মনে করছেন কি না, তার উপরে আমেরিকা এবং পশ্চিমী দেশগুলোর মনোভাব অনেকটাই নির্ভর করছে। তবে অনেকেই মনে করছেন, এত সহজে নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলবে না আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বরং তা ধীরে ধীরে তুলে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ দেবে। আমেরিকার তরফে আজ অবশ্য সু কির জয়কে স্বাগত জানিয়ে বলা হয়েছে, এই ভোট গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে বড় পদক্ষেপ।
এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কী ভূমিকা নিতে পারেন সু চি? নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী নেত্রী বলছেন, “আমার কাজ হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জঙ্গি-আন্দোলন বন্ধ করা এবং ২০০৮ সালের সংবিধানের সংশোধন করা। কারণ তাতে সেনাবাহিনীকে প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, পাঁচশোরও বেশি আসন বিশিষ্ট পার্লামেন্টে সেনার ভূমিকা কমানোই হবে তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে তাঁর প্রবল জনপ্রিয়তার জন্য পার্লামেন্টে খুব বেশি বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে না সু চি-কে। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সু চির জনপ্রিয়তার শরিক হতে চাইবেন অনেক এম পি-ই। কেউ কেউ অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে, সু চি জাদুকর নন। রাতারাতি কিছু করতে পারবেন না। বরং সেনা প্রভাবিত এই সরকারকে অনেক বেশি বিশ্বাস করছেন সু চি এবং সরকারও তাঁকে ব্যবহার করছে নিষেধাজ্ঞা তোলানোর জন্য। |