পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকার না-খেতে পাওয়া মানুষের থেকে আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে এঁদের অবস্থান শতহাত দূরে। এঁরা শিক্ষিত, উচ্চ মধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী পরিবারের শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্সে যাওয়া শ্রেণি। অথচ, তাঁদের অনেকের শরীরে পুষ্টির ঘাটতি হতদরিদ্র মানুষদের তুলনায় খুব একটা কম নয়! আর তাঁদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলে উদ্বিগ্ন পুষ্টি-বিশেষজ্ঞ বা ডায়েটিশিয়ানেরা। শনিবার নেতাজি ইন্ডোরে আনন্দবাজার পত্রিকা আয়োজিত স্বাস্থ্যমেলা ‘আরোগ্যম’-এ তথাকথিত সম্পন্ন শ্রেণির মধ্যে ক্রমবর্ধমান পুষ্টির অভাব নিয়ে আয়োজিত হয় এক আলোচনাসভা।
সম্পন্ন শ্রেণির হাতে টাকা আছে। খাবারও আছে। তা হলে পুষ্টি হচ্ছে না কেন? ডায়েটিশিয়ানেরা জানাচ্ছেন, কী খাচ্ছেন, কার কী খাওয়া উচিত, তা নিয়ে সচেতনতা না-থাকায় ওই খাবার কাজে লাগার পরিবর্তে ক্ষতি করছে। শরীর বেশি মোটা বা বেশি রোগা হচ্ছে। কারও দেহে লোহার পরিমাণ কমছে, কারও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, কারও ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেশিয়াম বা ভিটামিন ডি। ডায়েটিশিয়ানেরা বলছেন, “থাইরয়েড, ডায়াবিটিস বাড়ছে। অনেকেই চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছেন ঘাড়-হাত-পায়ে অসম্ভব ব্যথা নিয়ে। যথেষ্ট ঘুমোলেও ক্লান্তি কাটছে না। হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। সব সময়ে ঠান্ডা লাগছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, দুশ্চিন্তা বাড়ছে, মাংসপেশীর খিঁচুনি হচ্ছে। ঘুম হচ্ছে না। প্রথমে রোগ ধরা না-পড়ায় সবাই ভাবছেন ব্যাপারটা মানসিক। পরে দেখা যাচ্ছে পুরোটাই হচ্ছে পুষ্টির অভাবে।”
কেন মানুষ অর্থ থাকা সত্ত্বেও ঠিকমতো খাবার বাছতে পারছেন না? ডায়েটিশিয়ান হেনা নফিজ জানান, প্রথমত, খাবারের গুণাগুণ নিয়ে ভুল ধারণা যেমন, অনেকেই ভাবেন, পাঁঠার মাংস খাওয়া অনুচিত। কিন্তু পাঁঠার মাংসে প্রচুর ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আছে। কোলেস্টেরলের সমস্যা না-থাকলে ১৫ দিন বা মাসে একবার পরিমিত খাওয়া অবশ্যই উচিত। অনেকে ভাবেন, গরুর দুধ খাওয়ার উপযোগী নয়। কিন্তু হেনা নফিজের মতে, ক্যালসিয়ামের ঘাটতি মেটাতে দুধ গুরুত্বপূর্ণ। কোলেস্টেরল না-থাকলেও অনেকে ডিমের কুসুম খাচ্ছেন না। এতে ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি করেন হেনা। ঘি-মাখনের তুলনায় বাজারে যে ফ্যাট-ফ্রি মাখন পাওয়া যায়, সেগুলি অনেক বেশি ক্ষতিকর।
চার পাশে ফাস্ট ফুডের দোকানের রমরমা, মানুষের সময় কমে যাওয়ায় রান্না না করে জাঙ্ক ফুড বেশি খাওয়া ও খাবার সম্পর্কে অজ্ঞতা ও রোগা থাকার প্রবণতাকে পুষ্টির ঘাটতির জন্য দায়ী করছেন ডায়েটিশিয়ানেরা। অনেকে প্রোটিন, ভিটামিন, শাক-সব্জির বদলে বেশি কার্বোহাইড্রেট খাচ্ছেন, কালো হওয়ার ভয়ে রোদ্দুর লাগাচ্ছেন না। এতেও পুষ্টির অভাব হচ্ছে। ডায়েটিশিয়ান সুদেষ্ণা মৈত্রী নাগ জানান, গ্রাম ও শহরের কিছু স্কুলপড়ুয়ার উপরে একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, হুগলি বা বাঁকুড়ার গ্রামের একটি শিশু সব্জি, ডাল, পুকুরের মাছ খাচ্ছে। অথচ, আর্থিক ভাবে সচ্ছল একটি শিশু মাছ দেখলে নাক সিঁটকোচ্ছে। সারা দিন বার্গার, পাস্তা, চাউমিন, পিৎজা, চিপ্স বা কোল্ড ড্রিঙ্ক খাচ্ছে। পুষ্টি এমনিতেই কমছে।
ডায়েটিশিয়ান সর্বাণী ভট্টাচার্যের মতে, স্কুলে স্কুলে শিশুর মায়েদের নিয়ে ও অফিসেও কী খাওয়া উচিত তা নিয়ে নিয়মিত আলোচনাসভা হওয়া উচিত। পেস্ট্রির থেকে যে ফ্রুট-স্যালাড অনেক বেশি উপকারী, তা বোঝাতে না পারলে ধনীদের মধ্যে অপুষ্টি আরও বাড়বে। |