চৈত্রের মধ্যরাত। নবদ্বীপের প্রধান রাস্তা দিয়ে চলেছে এক চোখ ধাঁধাঁনো শোভাযাত্রা। মশাল, সার সার গ্যাসবাতির রোশনাইয়ে ঝলমলিয়ে উঠছে ঘুমন্ত বৈষ্ণবতীর্থ। শোভাযাত্রার শুরুতেই ঠেলাগাড়ি করে একের পর এক দৃশ্য পট সাজানো রয়েছে। দেবদেবীর মূর্তি, ভূত, পিশাচ, নকল বাগান। সঙ্গে বাজছে ঢাক ঢোল, ব্যান্ডের গান। চলছে নাচ। ফাটছে বাজি। রয়েছে ঝাড় লন্ঠনে সাজানো চলমান গেট।
আর তার পিছনেই সুদৃশ্য চর্তুদোলায় চলছেন বুড়ো শিব, যোগনাথ কিংবা বালক নাথ। অর্থাৎ নবদ্বীপের সাত শিবের যে কোনও একটি।
সাড়ম্বরে সেই শোভাযাত্রা নগরের বিভিন্ন পথ ঘুরে পৌঁছত পোড়ামাতলায়। সেখানেই হত আসল উৎসব। শিবের বিয়ে। বাসন্তীপুজোর দশমীর ভোরে বুড়োশিব আর যোগনাথ শিবের জোড়া বিয়ে হত। বিয়েতে স্ত্রী আচার, জলসাধা থেকে কোঁচানো ধুতি পরে বরযাত্রী যাওয়া কিংবা মালাবদল, কোনও কিছুই বাদ যেত না। তারপর চলত ঢালাও ভুরিভোজ। লুচি-মণ্ডা থেকে খিচুড়ি-আলুর দম বাদ যাত না কিছুই। শিবের বিয়ে নবদ্বীপের অন্যতম নিজস্ব লোক উৎসব। সব মিলিয়ে বৈষ্ণবতীর্থ চৈত্র মাসে যেন শিবক্ষেত্র হয়ে উঠত। আজও চলছে সেই ঐতিহ্য। বরং নতুন মোড়কে পুরোনো উৎসব জমে উঠছে।
সংস্কৃত গবেষক শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতি এখনও টাটকা হয়ে আছে আমার। পোড়ামাতলায় বিশাল মঞ্চ বাধা হত। সেখানে সাজানো হত শহরের বড় বড় দোকানের পোশাক থেকে আসবাব, সাইকেল থেকে কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র। যেন বিয়েতে শিবকে দেওয়া হয়েছে। থাকত বড় ঝুড়িতে লুচি আর মিষ্টি। বর যাত্রী পোড়ামাতলায় পৌঁছনোর পরেই তা সকলকে দেওয়া হত।” পুরাতত্ত্ব পরিষদের শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “সে কালে একেক জন ধনী মানুষ এক একটি শিবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ীই পোলাও, খিচুড়ির ভোজ হত।” তবে সত্তরের দশক থেকে উৎসবে কিছুটা ভাঁটা পড়ে। জাঁকজমক কমে, বুড়োশিব ছাড়া অনেক শিবেরই বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তবে এ বার আবার উৎসব ফিরেছে সেই চেনা চেহারায়। সোমবার রাতে বুড়োশিবের বিয়ে উপলক্ষে রয়েছে বুফের আয়োজন। ভোজের প্রধান আয়োজনকারী শান্তনু ভৌমিক বলেন, “শিবের বিয়ের পুরোনো ঐতিহ্য গত কয়েক বছরে অনেকটাই ফিরেছে। বাদ ছিল ভোজটা। তবে এ বার থেকে তাও আবার শুরু করা হয়েছে।” খাদ্যতালিকা কী ছিল? পোলাও, আলুর দম, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। দেড় হাজার মানুষের মতোই আয়োজন করা হচ্ছে।
বুড়ো শিব মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফে অমলেন্দু ব্রহ্মচারী বলেন, “আমরা প্রতিবার সম পরিমাণ লুচি আর শুকনো মিষ্টির আয়োজন করতাম। এ বার পুরনো ঐতিহ্যের একটা নতুন দিক উন্মোচিত হল।” |