তিন দশকের শাসনে বামফ্রন্ট বিবিধ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তর ক্ষতিসাধন করিয়াছে। কিন্তু অবক্ষয়ের দৌড়ে যে বিষয়টিতে বামফ্রন্ট সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছে, তাহার নাম উচ্চশিক্ষা। এই একটি ক্ষেত্রে গত তিন দশকের ইতিহাস এক নিরবচ্ছিন্ন অধঃপাতের ইতিহাস। এই অবনমনের মূলে একটিই ব্যাধি। বামফ্রন্ট তথা সি পি আই এম উচ্চশিক্ষার সমগ্র পরিসরটিকে দলীয় আধিপত্যের কুক্ষিগত করিয়াছিল। উৎকর্ষের সাধনা ব্যতীত উচ্চশিক্ষা সার্থক হইতে পারে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুক্ত স্বশাসন ব্যতীত উৎকর্ষের সাধনা অসম্ভব। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হইতে বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নীতি এবং কর্তব্য পরিচালিত হইলে যাহা ঘটিবার তাহাই ঘটিয়াছে দলের পৌষ মাস, শিক্ষার সর্বনাশ। এই গভীর অন্ধকারেও কিছু প্রতিষ্ঠান বা অন্তত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কিছু বিভাগ আপন মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছে, কিন্তু সেগুলি ব্যতিক্রম বই কিছু নয়।
বামফ্রন্টের বিদায়ে আশা জাগিয়াছিল যে, এই আধিপত্যের অবসান হইবে। কিন্তু বছর না ঘুরিতেই দেখা যাইতেছে, পুরানো ব্যাধি নূতন বোতলে বন্দি হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। বোতলের নাম উচ্চশিক্ষা সংসদ। একমাত্র না হইলেও, আপাতত এই বোতলটিই সর্বাধিক প্রকট। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হইতে পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য কে হইবেন, সেই বিষয়ে সংসদ নির্দেশ/পরামর্শ পাঠাইতেছে। রাজ্যের বিভিন্ন কলেজও এমন নির্দেশ/পরামর্শ হইতে বঞ্চিত হইতেছে বলিয়া মনে হয় না। সংসদের চেয়ারম্যান সুগত মারজিৎ বলিয়াছেন, ইহা তাঁহার আইনি এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে, এবং তাঁহার প্রস্তাবগুলি নির্দেশ নয়, পরামর্শমাত্র। তিনি ভুলিয়া যাইতেছেন যে, প্রশ্নটি আইন বা এক্তিয়ারের নয়। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট আপন এক্তিয়ারের মধ্যে থাকিয়াই সাম্রাজ্য বিস্তার করিয়াছিল। প্রশ্নের সম্মুখীন হইলে আলিমুদ্দিনও বলিত, তাহারা কোনও মত চাপাইয়া দেয় না, ‘নিজের লোক’দের বসাইয়া দেয় না, বড় জোর পরামর্শ দেয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘সমমনোভাবাপন্ন’ ব্যক্তিরা যদি তাহাদের প্রস্তাব বা অনুচ্চারিত মনোভাবের পক্ষেই সিদ্ধান্ত স্থির করেন, তাহাদের দোষ কোথায়? নূতন জমানায় উচ্চশিক্ষা সংসদের কর্ণধারও কি সেই রাগিণীতেই আলাপ শুরু করিলেন?
সুগতবাবুর উদ্দেশ্য মহৎ কি না, সে প্রশ্ন ব্যক্তিগত, সুতরাং অবান্তর। প্রশ্ন আচরণের। ‘পরামর্শ’ দিবার ক্ষমতা থাকিলেও একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত সেই ক্ষমতা প্রয়োগ না করাই যথার্থ গণতান্ত্রিক আচরণ। প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ সংসদপ্রধান নিশ্চয়ই জানেন, ক্ষমতাবানের পরামর্শ কার্যত নির্দেশ হিসাবেই গণ্য হয়, বিশেষত যখন সেই পরামর্শের পিছনে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকে এবং সেই সর্বোচ্চ স্তরের কথা না শুনিলে শাস্তি বা বিড়ম্বনার আশঙ্কা যখন প্রবল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিজের মতো চলিতে দিলে তাহার পরিণাম সর্বত্র শুভ না হইতেই পারে, কিন্তু স্বশাসনের মধ্য দিয়াই তাহাদের আত্মসংশোধনের সুযোগ দিতে হইবে, গণতন্ত্রে অন্য সুপথ নাই। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা দ্বিগুণ জরুরি, কারণ এই রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটি বড় অংশ সি পি আই এমের পৌরোহিত্যে দীর্ঘদিন কর্তাভজা সংস্কৃতির অনুশীলনে অভ্যস্ত হইয়াছে, তাহাদের চিন্তায় ও আচরণে কর্তাদের খুশি করিবার তাগিদ অত্যন্ত জোরদার। স্বশাসনের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হইতে তাহাদের কিছু সময় লাগিবে। কিন্তু নূতন জমানাতেও ‘বড়কর্তা’রা তাহাদের পরামর্শ দিতে শুরু করিলে তাহারা সেই পরামর্শকে নির্দেশ বলিয়াই শিরোধার্য করিবে, স্বশাসন আসিবে না। বুঝিতে হইবে, কর্তা (বা কর্ত্রী) পরিবর্তিত হইয়াছেন, ভজনা অপরিবর্তিত। ‘এখন সন্ধিক্ষণ, তাই এখন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সংসদের সাহায্যের প্রয়োজন’ এই যুক্তি আধিপত্যের যুক্তি, অর্থাৎ কুযুক্তি। পশ্চিমবঙ্গ তিন দশক ধরিয়া আধিপত্যের বহু কুযুক্তি শুনিয়াছে, আর নয়। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের আর একটি শাখা খুলিবার প্রয়োজন নাই। |