|
|
|
|
তবু কেন আজও তাকে আগলে বসে থাকা |
একটি রাত। দু’টি খাতা। প্রিয়জন। সকালবেলার তাজা বিশ্বাস। যা হারিয়ে যায়, তবু যায় না।
|
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় |
হারিয়ে যাওয়ার কি আর শেষ আছে? স্মৃতি হারায়। একটা সময় হয়তো বিস্মৃতিও হারায়। কিছু থেকে যায়, তবু। আক্ষেপের মতো। বেদনার মতো। আবার, সুখেরও মতো, যেন বা। যদি আচমকা জীবন্ত হয়ে ওঠে ঝাপসা কোনও ফোটো! ঠিক কোন ছবিটা, একবচনে জানাতে বললে একটু সমস্যায় পড়ব, সন্দেহ নেই। তবু, একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। তখন ‘অপুর সংসার’-এর শুট চলছে। নেতারহাটে যাব, জঙ্গলের দৃশ্যটা তোলা হবে। আমি একটি প্রথম শ্রেণির কুপেতে। সহযাত্রী স্বয়ং মানিকদা! সেই রাতটা আমরা ঘুমোইনি। ট্রেন হাওড়া ছাড়ার পরে শুরু হয়েছিল কথা। আমি প্রশ্ন করছি, মানিকদা উত্তর দিচ্ছেন। আরও কত কী বলছেন। প্রসঙ্গ, সিনেমা তো বটেই, শিল্পও। আমার জানার আগ্রহ ছিল খুব, আর সঙ্গে সত্যজিৎ রায়! কথায় কথায় রাতভর চলল সেই ক্লাস! অন্ধকারে ছুটে চলেছে রেলগাড়ি, আমরাও বিনিদ্র। ওই একটি রাতে সিনেমা ও শিল্প নিয়ে যা শিখেছিলাম, সেই স্মৃতি আজও মোছেনি। যদি ফিরে আসত সেই রাত! মানিকদা ব্যারিটোনে ডাকছেন, সৌমিত্র...
|
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় |
তখন আমার সাত বছর বয়স। কাটিহারের রেলের বাংলোয় এক দিন দুপুরে একটা টেলিগ্রাম এল। বাবা বজ্রাহত, মায়ের চোখে জল। কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কী হয়েছে মা? কী হয়েছে? সাত বছর বয়সের ছেলেকে কেউ কিছু বুঝিয়ে বলতে চায় না। শুনতে পাচ্ছি, দাদু মারা গেছে। কিন্তু মারা যাওয়াটা কী জিনিস? তার মানে কি দাদুর সঙ্গে এক পাতে বসে খাওয়া, দাদুর কাছে স্নান, দাদুর পাশে ডেকচেয়ারের হাতলের ওপর ঘোড়ায় চেপে বসে থাকা, সব শেষ? তাই কি হয়? হতে পারে? কবে দাদুর কাছে যাব, সেই ভেবে পথ চেয়ে সারা বছর বসে থাকতাম যে! দাদু ছাড়া কি কিছু হয় নাকি?
পর দিন বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে ময়মনসিংহ রওনা দিই। সেখানেও বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল। আছাড়িপিছাড়ি। আমি চুপি চুপি গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, বড় ঘরে দাদুর বিছানা, ডেকচেয়ার, বেঁটে আলমারির মাথায় আফিমের কৌটো, গড়গড়া, সবই তো আছে। বালিশে তিল তেলের গন্ধ অবধি লেগে আছে এখনও। তবে লোকটা গেল কোথায়?
জেঠিমাকে বললাম, দাদু গেল কোথায় বলো তো! সবাই কাঁদছে কেন? আমি যে দাদুর কাছে যাব। জেঠিমাই একমাত্র সত্যি কথাটা বলল, দুর দুর তোর দাদুর কিছু হয়নি। কেওটখালির একটা বাড়িতে ক’দিনের জন্য থাকতে গেছে। এসে পড়ল বলে। ভারী নিশ্চিন্ত হলাম। দৌড়ে গিয়ে খবরটা মাকে দিলাম। মা কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
তার পর থেকে রোজ সকাল-বিকেল গিয়ে বারবাড়ির মাঠে দাঁড়িয়ে থাকি। দাদু আসবে। হঠাৎ একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে থামবে, আর হাসিমুখে নেমে আসবে দাদু। কত কত দিন যে অপেক্ষা করেছি, তার হিসেব নেই। আমাকে ছেড়ে দাদু থাকতেই পারত না। দাদু আসবেই।
দাদু আর এল না। আসার কথাও নয়। কিন্তু সেই যে বড় বিশ্বাস হয়েছিল দাদু আসবে, সে রকমটা, এখন আর হয় না। কোথায় যে হারিয়ে গেল সেই সরল বিশ্বাস! তাকে আজও খুঁজি, তাকে আজ আমার বড় দরকার।
|
যোগেন চৌধুরী |
দিন সাতেক হল আলমারিতে আমার ছোটোবেলার পদ্য আর ছড়া লেখার খাতাটা খুঁজতে গিয়ে দেখি সেটা কোথাও নেই। ... এই সঙ্গে দেখি আমার জীবনের প্রথম স্কেচ খাতাটিও সেখানে নেই।... যে দিন থেকে ও দুটিকে খুঁজে পাচ্ছি না, সেদিন থেকে আমি মনে প্রাণে বিমর্ষ হয়ে আছি। ওই খাতা দুটি ছিল শৈশবের সঙ্গে আমার যোগসূত্র। প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি ছড়া বা স্কেচ আমাকে মনে করিয়ে দিত সেই সময়ের কথা, আমার পরিবেশ, পরিচিত মানুষজনের কথা আমার মনের সুখ, দুঃখ, বেদনা, ভালোবাসার কথা। কতদিন ওই খাতা দুটিকে নিয়ে বহু সময় কাটিয়েছি। একটি একটি পৃষ্ঠা দেখতে দেখতে কত কিছু মনে পড়ত তখন।... নতুন কোনো কবিতা বা খুব দামি ছবিও ওর কোনো বিকল্প হয়ে উঠবে না। অথচ বিষয়টি নিতান্তই তুচ্ছ। সমস্ত জীবনের অস্তিত্ব, জন্ম, মৃত্যুর কাছে নিতান্তই একটি গৌণ বিষয়। আমাদের পরিবারেও এর থেকে দুঃখজনক ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। তবু রোজ একবার করে স্টুডিওর সেই আলমারিটি খুলে দেখি, কী জানি, যদি হঠাৎ করে ওই খাতা দুটিকে খুঁজে পাই!
সূত্র: হারিয়ে গেছি আমি (একটি গন্ধর্ব প্রকাশন)
|
ঊষা উত্থুপ |
হারিয়ে যাওয়া আমার কাছে কোনও এক ভাবে আসেনি, এসেছে নানা স্তরে। পেন-টেন তো এন্তার হারিয়েছি। এখন আর অত ভাবি না। না, ভুল বললাম, আফশোস হয় মাঝেমধ্যেই, যখন হয়তো দেখি, খুব প্রিয়, খুব কাছের, খুব অভ্যস্ত একটা জিনিসই হারিয়ে গিয়েছে। আসলে মায়া কাটে না তো সহজে। সুযোগ হারিয়ে ফেলার পর অবশ্য অত কিছু ভাবার সময় পাই না। দুঃখ করতে বসলে তো পরের সুযোগটাও সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। পেন হারানোটা যেমন একটা স্তর, সুযোগ হারিয়ে ফেলাটা অন্য স্তর। এই দুটো স্তরে যা হারাই, সে দুঃখ সামলে নিই অন্য কোনও বিকল্প দিয়ে, কিন্তু যে হারানোটা কখনও কেউ সামলাতে পারবে না, তা হল আমার দাদার মৃত্যু। ক্যানসারে।
১৪ নভেম্বর, একটা শো করে বাড়ি ফিরেই শুনলাম, দাদার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, এক্ষুনি বম্বে যেতে হবে। বাবা বোধ হয় আঁচ করেছিলেন, দাদা আর থাকবে না। তাই দাদাকে হাসপাতালে দেখে এসে স্নান সেরে, পরিচ্ছন্ন ধুতি-পাঞ্জাবি চাপিয়ে, গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করে শুয়ে পড়লেন। জানলাম, বাবা কোমায় চলে গিয়েছেন। দাদা কিন্তু তখনও বেঁচে। পর দিন দাদা মারা গেল। আর বাবা, তিন দিন পর। মানে বাবা কিন্তু দাদাকে মৃত দেখলেনই না।
বাবা জীবনটা পুরো দমে বেঁচে নিয়েছিলেন, কিন্তু দাদার তো তখন সবে ৪০। তাই দাদাকে হারিয়ে ফেলাটা আজও কুরে কুরে খায়। |
|
|
|
|
|