|
|
|
|
সোফোক্লেস, স্যাফো, চার্বাক |
এবং আরও অনেকে। যাঁদের অনেক লেখাই হারিয়ে গিয়েছে, হয়তো বা সব লেখাই। চিরদীপ উপাধ্যায় |
উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের সেই ভাগ্যান্বেষী নাট্যকারকে মনে আছে? প্রিয়নাথ মল্লিক? ‘দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা’র কাপ্তেন বেণীমাধব চাটুজ্জেকে তাঁর লেখা ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নাটক পড়তে দিয়ে গিয়েছিলেন, যদি বাবুর পছন্দ হয়। কিছু দিন পরে যখন খোঁজ করতে এলেন, তার কোনও হদিশ পাওয়া গেল না। প্রিয়নাথকে পাত্তাই দেন না বেণীমাধব, মুড়ি খেতে বলেন। কাগজের ঠোঙায় মুড়ি খেতে খেতে হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠেন নাট্যকার, ‘‘পলাশীর যুদ্ধ, পৃষ্ঠা তিনশত একুশ... আমার অমন নাটক দিয়ে মুড়ির ঠোঙা বানিয়েছে। মাই মাস্টারপীস!” ক্রমে আরও আরও পাতাগুলি দলের বিভিন্ন কুশীলবের হাত থেকে আবিষ্কৃত হয়।
খুব মায়া হয়েছিল প্রিয়নাথের জন্যে। তখন জানতাম না, ইডিপাস এবং আন্তিগোনের স্রষ্টা গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লেস-এর সাতটি গোটা নাটক বেঁচে আছে, হারিয়ে গেছে শতাধিক। আড়াই হাজার বছর আগেকার গ্রিসের অন্য দুই নাট্যকার ইউরিপিডিস এবং ইস্কিলাস-এর রেকর্ডও সাংঘাতিক। ইউরিপিডিস: প্রায় ১০০’র মধ্যে পাওয়া গেছে ১৮টি। ইস্কিলাস: আছে ৮, গেছে ৭৩। তিন জনেরই নানান নাটকের টুকরোটাকরার সন্ধান মিলেছে, কিন্তু গোটা নাটক বলতে তিন-তিরিক্কে ওই ৩৩। কষ্ট হচ্ছে? তবে মনে রাখা ভাল, সেই যুগের গ্রিক ট্র্যাজেডির স্রষ্টাদের মধ্যে এঁরা রীতিমত ভাগ্যবান, অন্য অনেকেরই অখণ্ড নাটক বলতে কার্যত কিছুই বেঁচে নেই।
হারিয়ে গিয়েছে স্যাফো-র অগণিত কবিতাও। প্রাচীন গ্রিসের এই অসামান্য সৃষ্টিশীল এবং স্বতন্ত্র নারীর অধিকাংশ কবিতাই কালক্রমে অন্তর্হিত, ছিন্নবিচ্ছিন্ন কিছু কিছু পঙ্ক্তি আমাদের সম্বল, যার অল্প কিছু, প্যাপিরাসে লেখা, আবিষ্কৃত হয়েছিল উত্তর মিশরের মাটি খুঁড়ে। বাকি যা আছে, সবটাই অন্যের উদ্ধৃতিতে, যে উদ্ধৃতি প্রায়শই গুণমুগ্ধ কোনও উত্তরসূরির প্রগাঢ় প্রশস্তির সঙ্গী। সেই সব প্রশস্তিতে জানা যায়, রোমান আমলেও অনেক দিন পর্যন্ত স্যাফোর কাব্যগ্রন্থগুলি ছিল, তার পর ভ্যানিশ। ঠিক কবে, কেউ জানে না, তবে দ্বাদশ শতকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের এক পণ্ডিত ঘোষণা করলেন, স্যাফোর কবিতা আর কোথাও নেই। স্যাফোর রচনাশৈলী ক্রমে কবিদের অপছন্দ হয়ে পড়েছিল বলেই নাকি এই পরিণতি। কে জানে, হয়তো বা অন্য কারণও ছিল, নারীর প্রতি নারীর তীব্র কামনার বহু সঙ্কেতে আশ্লিষ্ট তাঁর কবিতা হয়তো মহাকালের সহ্য হয়নি। মহাকাল বলে কি পুরুষ নয়? তবে, অয়ি ট্রিগারে-আঙুল-রাখা নারীবাদী, তিষ্ঠ ক্ষণকাল স্যাফোর সমকালীন অনেক গ্রিক কবির এক লাইনও জীবিত নেই, এবং তাঁদের অধিকাংশই পুরুষ।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের প্রবক্তারাও, অন্তত তাঁদের অধিকাংশই, পুরুষ ছিলেন। তাঁদের লেখালিখিও বেবাক লোপাট হয়ে গিয়েছে। তাঁদের বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি পরবর্তী কালের দাপুটে ভাববাদীদের ভয়ানক বিরাগ ছিল। গভীর আশঙ্কাও ছিল পরলোকের চিন্তা না করে ঋণং কৃত্বা ঘৃত পানের চার্বাকবচন কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিলে কে আর বেদ বেদাঙ্গ বেদান্তের পরোয়া করবে? অতএব যেখানে চার্বাক দর্শনের পুঁথিপত্র দেখবে, ধ্বংস করে দাও। ক্রমে ক্রমে সব শেষ হয়ে গেল। এবং হল না। চার্বাক মতের বিরোধীরা বস্তুবাদকে খণ্ডন করতে বসে বিধি অনুসারে প্রথমে সেই প্রতিপক্ষীয় তত্ত্বের সারকথাটা বলে নিতেন, তার পর নিজেদের তত্ত্ব দিয়ে সে মত খণ্ডন করতেন। এ দিক থেকে মহামূল্যবান একটি আকরগ্রন্থ হল মাধবাচার্যের সর্বদর্শনসংগ্রহ, চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রণীত এই গ্রন্থে বেদান্তবাদী পণ্ডিত চার্বাকদর্শনের সারাৎসার লিপিবদ্ধ করেছিলেন, অতঃপর খণ্ডন। এই ভাবেই বিরোধীদের লেখায় চার্বাক দর্শন থেকে গেল। ভাগ্যিস সে কালের তার্কিকরা এ কালের মতো ছিলেন না, তা হলে কেবল নিজেদের মতই লিখতেন, বিপক্ষের অভিমত নথিভুক্ত করার কোনও চেষ্টাই করতেন না। আমরা চার্বাক নামটাও জানতে পারতাম না।
ছাপাখানা আসার আগে পুঁথিপত্র হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা স্বভাবতই বিপুল ছিল। এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে যাঁদের বই হারিয়ে গিয়েছে বলে আমরা জানি বা অনুমান করি, তাঁরা নিতান্তই সংখ্যালঘু, আরও অগণিত লেখা নেই হয়ে গিয়েছে, যার কথা আমরা জানিই না, জানবও না কোনও দিন। এ কালেও বই হারানোর গল্প শেষ হয়ে যায়নি। মুদ্রিত গ্রন্থকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নানা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। যেমন কিছু নির্দিষ্ট গ্রন্থাগারে প্রতিটি প্রকাশিত বইয়ের এক কপি করে পাঠাতে হবে, এই নিয়মটি অনেক বইকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবু, হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না যে, যা কিছু ছাপা হয়, সবই কোথাও না কোথাও থেকে যায়, যায়ই। আর পাণ্ডুলিপি? যত দিন হাতে লেখা বা টাইপ করা কাগজই সম্বল ছিল, তত দিন বই ছাপা হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রতিটি পাণ্ডুলিপিই ছিল বিপন্ন প্রজাতি, মাধ্যমিকের খাতার মতো। পাণ্ডুলিপি হারানোর অনেক কাহিনি আছে। কেবল একটির কথা বলি। ১৯২২ সালে তেইশ বছরের তরুণ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সুইটজারল্যান্ডে যাচ্ছিলেন, পথে তাঁর ট্রাঙ্কটি চুরি হয়ে যায়। সেই ট্রাঙ্কে ছিল তাঁর যাবতীয় লেখালিখি। নতুন করে লেখা শুরু করেন তিনি। সম্পূর্ণ নতুন স্টাইলে। ভারহীন, নির্মেদ গদ্য, সোজা দৃষ্টি, সাফ কথা। হেমিংওয়ে বলতে ঠিক যেমনটি মনে পড়ে। যদি ট্রাঙ্কটি খোয়া না যেত, কে জানে, হয়তো অন্য এক আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে পেতাম আমরা। ভাল হত?
হারিয়ে যাওয়া পুঁথিপত্রের গল্পের নটেগাছ মুড়োনো যাক উল্টো এক কাহিনি দিয়ে। ১৯০৭ সালে নেপালরাজের গ্রন্থাগারে সাতচল্লিশটি ‘পদ’ সংবলিত পুঁথি খুঁজে পেলেন বাঙালি পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। চর্যাপদ। কেবল সহস্রাব্দ আগেকার ‘হারিয়ে যাওয়া’ পুঁথি আবিষ্কৃত হল না, নতুন করে লেখা হল বাংলা ভাষার জন্মবৃত্তান্ত। এমন উজ্জ্বল উদ্ধার আর দুটি হয়?
|
|
|
|
|
|