|
|
|
|
এক্কেবারে উধাও? ব্যস? |
পৃথিবীতে প্রত্যেক মুহূর্তে কিছু না কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলোই চিরতরের জন্য। আর তার মধ্যেই এমন কিছু আছে,
যার ব্যাখ্যা আমাদের কাছে আজও নেই। একটি ছোট্ট লিস্ট। অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
এল ডোরাডো |
|
ছবির নাম ‘এল ডোরাডো’ (১৯৬৬) |
ষোড়শ শতকের কথা। দেশবিদেশের বাঘা বাঘা সব অভিযাত্রী তখন মুহূর্তেই এঁকে ফেলছেন নয়া মানচিত্র। আর সেই লাইন অনুসরণ করেই এক সময় দক্ষিণ আমেরিকা পৌঁছে গেলেন কিছু স্প্যানিশ পর্যটক। পাখির চোখ এল ডোরাডো। সেই যেখানে নাকি হাত ফেরালেই সোনা পাওয়া যায়। থরে থরে সোনা। তত দিনে সব্বাই নিশ্চিত, আশেপাশে মস্ত সোনার খনি আছে। নইলে মুইসকা জনজাতিতে যে দিন নতুন রাজার নির্বাচন হয়, সে দিন তাঁকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকার অত সোনা জোগান দেয় কে? শুধু তাই? এর পর তো ওরা হুয়াটাভিটা হ্রদে গিয়ে থালা থালা সোনাও ফেলে আসে। খোঁজ খোঁজ।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, লোকে বিফলমনোরথ হয়ে ফিরে যায়। অ্যান্ডিজ পাহাড় থেকে শুরু করে প্রায় গোটা মহাদেশ চষে ফেলা হল, তবু এল ডোরাডো পাওয়া গেল না। ব্যাপার কী? উবে গেল নাকি?
উবে যায়নি, কারণ এল ডোরাডো বলে কিছু ছিলই তো না কখনও। সব আসলে সোনার চমক, যা চোখের আগেও মনকে ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। আর মুইসকা জনজাতির অঢেল সোনা? সে কোনও গুপ্ত খনির জোগান নয়, এন্তার বাণিজ্যের ফলমাত্র। কেউ না বুঝুক, মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো আসল কথা বুঝেছিলেন, তাই বলেছিলেন, এল ডোরাডো যেতে চাও, তবে চাঁদের পাহাড় পেরিয়ে, ছায়ার উপত্যকা ছাড়িয়ে, হেঁটে যাও, শুধু হেঁটে যাও...
|
সরস্বতী নদী |
স্কন্দপুরাণ বলছে সরস্বতী নদীর জন্ম ব্রহ্মার কমণ্ডলু থেকে। তার পর হিমালয় থেকে নামতেই একেবারে মহানায়িকার শিরোপা। ঋগ্বেদে সরস্বতীর অবস্থান দেখানো হয়েছে যমুনা ও শতদ্রুর মাঝে। এমন তোড় যে পাহাড়েই ফাটল ধরিয়ে দেয়। আর, মায়ের মতো বুক উজাড় করে পালন করে আপন ধারায় বিধৌত অঞ্চলকে। কিন্তু তার পরই সরস্বতী ক্রমে হারিয়ে যেতে লাগল। সমুদ্রে গিয়ে পড়ার আগেই। প্রথমে কিছু অংশ বুজে গেল, তার পর আস্তে আস্তে পুরোটাই নিভে গেল মরুভূমির তলায়। থর মরুভূমির তলায়।
গবেষণা চলছে এখনও, খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে আসল সরস্বতী, তার যাত্রাপথ। কিছু মানুষ আজকের ঘগ্গর-হাকড়া নদীকেই সে যুগের সরস্বতী বলে মানছেন। আবার রাজেশ খোশরের মতো জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী মনে করেন, আফগানিস্তানের হেলমান্ড নদীই নাকি আসল সরস্বতী। সত্যি হল, আমরা এখন শুধুই স্মৃতি হাতড়ে চলেছি।
|
চেঙ্গিজ খানের কবর |
১২২৭। মঙ্গোলিয়ার লিউপান পর্বত অঞ্চলে ধুন্ধুমার যুদ্ধ চলছে। প্রায় অর্ধেক পৃথিবী চেঙ্গিজ খানের হাতের মুঠোয়, এই জয় এনে দেবে আরও ঐশ্বর্য। হঠাৎ ছন্দপতন। খোদ চেঙ্গিজই পড়ে গেলেন ঘোড়া থেকে। বোঝা গেল, আর বেশি দিন নয়। মৃত্যু ঠেকানো অসম্ভব, কিন্তু মৃত্যুর খবর? সে তো চেপে যাওয়া যায়। কারণ সর্বেসর্বার পতনের খবর পেলে তো হাজার হাজার পা স্তব্ধ হয়ে যাবে, এত দিনের পরিশ্রম ধুলো হয়ে যাবে। তবে?
প্রায় ২৫০০ ভক্ত ও আরও কিছু সৈন্যের চোখের সামনে ভগবানকে কবর দেওয়া হল। এর পর? সত্য কল্পনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। চেঙ্গিজের বাহিনি নৃশংস ভাবে খুন করল সবাইকে, যাঁরা তাঁর এই অন্ত্যেষ্টির সাক্ষী থেকেছেন। একে একে খুন হলেন তাঁরাও, যাঁরা রাজার কবর খুঁড়েছেন। এখানেই শেষ নয়। দেশে ফিরে এলে, সেই সব সৈনিককেও মরতে হল, যারা এর আগের হত্যালীলা চালিয়েছিল। খবর লুকিয়ে রাখার আর কোনও উপায় থাকতে পারে?
পারে। এক দল বলে, এই জায়গায় নাকি একটা একটা করে গাছ পুঁতে আস্ত জঙ্গল তুলে দেওয়া হয়েছে, আর অন্য দল বলে চেঙ্গিজের কবরের ওপর দিয়ে নাকি একটা নদীই বইয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই বলা ভাল, চেঙ্গিজের কবর মঙ্গোলিয়ার কোথাও একটা আছে। হয়তো বা।
|
অ্যাটলান্টিস |
|
ডিজনি’র অ্যাটলান্টিস ছবির দৃশ্য |
ছোট থেকেই আমরা শুনেছি অ্যাটলান্টিসের গল্প, কী প্রতাপ তথাকার মানুষজনের, সমস্ত পৃথিবী অমন দাপট আগে কখনও দেখেনি। আর তার পর এক দিন বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে জলের তলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মনে আছে, প্রতিজ্ঞা করতাম, বড় হয়ে এক দিন ওই গহিন জল থেকে তুলে আনব স্বপ্নের রাজ্য। তার পর তো জেম্স ক্যামেরন এলেন, টাইট্যানিক তুললেন, মনে বল পেলাম। শুনলাম অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বের করে ফেলেছে অ্যাটলান্টিস-এর ঠিক ঠিক অবস্থান। ভূমধ্যসাগরে, অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে, স্পেনে, কিউবায়, অ্যান্টার্কটিকায়... যাঃ!
কিন্তু প্লেটো যে বললেন? ওই, ওখান থেকেই তো সমস্ত ধাঁধার শুরু। মানে প্লেটো’র লেখায় প্রথম আমরা স্পষ্ট ভাবে পাই এই অ্যাটলান্টিসের কথা। পিলার অব হারকিউলিস-এর কাছে অবস্থিত এই অসাধারণ নৌশক্তি। এশিয়া, আফ্রিকা কেউ ছাড় পায়নি এর হাত থেকে। শুধু বশ করা যায়নি এথেন্সকে। উল্টে এক দিনের দুর্ভাগ্যে অ্যাটলান্টিসই কোথায় যেন তলিয়ে গেল। তার পর কত চেষ্টা চলেছে হারিয়ে যাওয়া রাজ্য খুঁজে পাওয়ার। হাতে উঠে এসেছে শুধুই পেন্সিল।
কিন্তু প্লেটো যে বলেছিলেন? অনেকে বলেন, আমরা একেবারেই বুঝিনি প্লেটো কী বলেছেন। তিনি মোটেই কোনও এক নির্দিষ্ট রাজ্যের দিকে আঙুল দেখাননি। প্লেটো ‘ফ্যাক্ট’ দেখাচ্ছিলেন না, ‘ফিকশন’ বুনছিলেন। নাকি, ‘আইডিয়া’? হয়তো দেখাতে চাইছিলেন একটি রাজ্য পরিচালনা করার সেরা উপায়। হয়তো বা বলছিলেন একটি ‘ইউটোপিয়া’র কথা। আর তাই তো অ্যাটলান্টিস আজও অধরা।
|
বার্মুডা ট্রায়াঙ্গল |
|
ফ্লোরিডা, বার্মুডা ও পুয়ের্তো রিকো। অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের সেই সাংঘাতিক ত্রিকোণ। ছোটবেলা তো রুদ্ধশ্বাস হত ডানিকেন, বার্মুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়েই। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯-এর মধ্যে বেশ কয়েকটা উড়োজাহাজ স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল এখানে। তারও আগে অবশ্য, কিছু জাহাজও এই অঞ্চল পেরোতে পেরোতে মাঝপথেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কী এমন আছে এখানে, যা মুহূর্তেই গিলে ফেলে সব কিছু? এমনকী সর্বশক্তিমান আমেরিকান বোমারু বিমানকেও! ফ্লাইট ১৯-এর পাঁচটি বোমারু বিমান এক সঙ্গে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল দুম করে, তাকে খুঁজতে পাঠানো আরও এক বিমানেরও হল ওই একই অবস্থা। পৃথিবী জুড়ে চাউর হয়ে গেল, এই অঞ্চল অভিশপ্ত, এখানে এমন কোনও অজানা শক্তি কাজ করে, যা মানুষের বোধগম্য নয়। হয়তো ভিনগ্রহের প্রাণী! হয়তো এটি শেষের সিগনাল?
হয়তো-র জগৎ ছেড়ে বেরোনো গিয়েছে শেষ পর্যন্ত। এখন আমরা জানি, যে ভিনগ্রহ-টহ কিচ্ছু না, সব ঘটনাই বিজ্ঞান দিয়ে বুঝে ফেলা যায়। বিপত্তির কারণ কখনও চরম আবহাওয়া, কখনও বিধ্বংসী একটা হারিকেন, বা কখনও হয়তো সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া জোরদার গাল্ফ স্ট্রিম। আর কখনও নিছক মানুষের মনের ভুলই। এখন বিজ্ঞান মারাত্মক স্মার্ট হয়ে গিয়েছে, তাই অসাবধানতা বা ভুলও সংখ্যায় কমেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন: যারা হারাল, তারা হারাল কোথায়?
|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল |
অন্ধকার মাপার যন্ত্র থাকলে ঠিক দেখা যেত, ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ আসলে কী মারাত্মক কালো ছিল। বাঙালির কাছে তো বটেই। পর দিন সকালেই তো দেখা গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরি হয়ে গিয়েছে। তার পর প্রবল হইচই, মাথায় বাজ ভেঙে পড়া, ঘোর কলি ইত্যাদি। মোড়ে মোড়ে নানান তত্ত্ব: গভীর ষড়যন্ত্র, কেন্দ্রের বঞ্চনা, সাম্রাজ্যবাদী কালো হাতের কারবার, এমনকী বর্ডার পেরিয়ে সাদাসিধে স্মাগলিং পর্যন্ত। কিন্তু আখেরে কিছু হল কি? একটি সিনেমা ছাড়া?
নোবেল কমিটি একটি রেপ্লিকা পাঠিয়ে দিয়েছে, সি বি আই-এর ফাইল ঘুমিয়ে গিয়েছে আর আমরা মনকে বুঝিয়ে নিয়েছি, ও নোবেল তো চুরি যায়নি, স্রেফ হারিয়ে গিয়েছে। যেমনটা যায় গ্র্যান্ডফাদার ক্লক, ভদ্রতা, সৎ পুলিশ অফিসার, সবুজে সবুজ তুমি নীলিমায় নীল।
|
দ্বারকা |
কৃষ্ণ যে দিন বুঝলেন, বাকি যাদবদের নিয়ে তাঁকে এ বার মথুরা ছাড়তেই হবে, সে দিন তিনি ঠিক করলেন, পশ্চিম উপকূলের দিকে আরও এগিয়ে যাবেন। পছন্দ হল সমুদ্রের পাশেই একটি জায়গা। তক্ষুনি বিশ্বকর্মার দ্বারস্থ হলেন, বললেন, এখানেই আমায় বানিয়ে দিন নতুন শহর। বিশ্বকর্মা সব দেখে-টেখে বললেন, সমুদ্রের থেকে জমি আদায় করতে হবে! জমি আদায় হল। যাকে আমরা জানি ‘রিক্লেমেশন অব ল্যান্ড ফ্রম সি’ বলে। তৈরি হল কৃষ্ণের দ্বারকা।
মহাভারতের কথায়, সে দ্বারকা জলের গভীরে তলিয়ে গেল কৃষ্ণ ইহলোক ত্যাগ করার পরেই। কেউ বলে সুনামি, কেউ বলে সমুদ্র বাঁধ ভেঙে শহরে ঢুকে সব তছনছ করে গেল। মোদ্দা কথা হল, দ্বারকা চিরতরে হারিয়ে গেল। অনুসন্ধান এখনও চলছে, আরব সাগরের নীচে বাড়ি, রাস্তা, রাজপ্রাসাদ সবেরই ধ্বংসস্তূপ পাওয়া গিয়েছে নাকি, কিন্তু এত চাপানউতোরের পর আসল কেষ্টই যে পেলাম, জানব কী করে?
|
|
|
|
|
|