|
|
|
|
নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা |
দিশেহারা মাঠে, দিক্শূন্যপুর, যেখানে হোক, চাইলেই হারানো যায়। তার পর মাইকে নিজের নাম শোনা।
ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার গল্প, হারিয়ে যাওয়ার মজা। অনুব্রত চক্রবর্তী |
এই গল্পের মূল দু’টি চরিত্র কাল্পনিক নয়। নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কলজে দু’টি ইনট্যাক্ট!
এই সেই ট্যাঁপা, এই সেই টেঁপি। স্ব স্ব পিতা মাতা। হাত ধরা। এক জনের চোখ গোল, মুখ হাঁ। অন্য জন জোড়া বিনুনি, তিড়িং-বিড়িং। দু’সেট বাবা-মা, দু’টাকার টিকিট কেটে ময়দানের মেলায়। ‘এটা কি রথের মেলা বাবা?’ ট্যাঁপার প্রশ্ন। ‘হস্তশিল্প’ বাবার জবাব। এক দিকে বেতের চেয়ার, অন্য দিকে মাটির হাঁড়ি, বাঁকুড়ার ঘোড়া। টেঁপির চোখ আইসক্রিমে। ট্যাঁপার এত হাতে এক ঠোঙা চিনেবাদাম। এক ধাক্কায় ঠোঙা উলটে যাওয়ার উপক্রম। একটু সামলে উঠে ট্যাঁপা দেখে বাবা-মা হাওয়া! ও দিকে টেঁপির হাতে আইসক্রিম দেখে এক বজ্জাত কাক তেড়ে আসছে ক্রমাগত। একটু আইস-স্পাইস খেলা যাক না! এর কিছু ক্ষণ পরেই মেঘমন্দ্র স্বরে সেই স্বর্গীয় ঘোষণা ‘বাঁশদ্রোণী থেকে এসেছে ট্যাঁপা, নাগেরবাজার থেকে টেঁপি। এদের বাবা-মা বা বাড়ির লোক দয়া করে আমাদের অফিসে চলে আসুন’...ইত্যাদি। মেলার অফিসে চোখ গোল, মুখ হাঁ ট্যাঁপা আর জোড়া বিনুনি, ঠোঁট ফোলানো টেঁপি স্ট্যাচু! ‘কেঁদো না খুকি’, ‘কেমন বাপ-মা এদের’, ‘এ বার থেকে বাচ্চাদের আই-কার্ড মাস্ট’, ‘আমি এক বার ছোটবেলায় ছোড়দাদুর সঙ্গে...’। ফেরার পথে ট্যাঁপার হাতে আর এক ঠোঙা চিনেবাদাম আর টেঁপির হাতে আর একটি আইসক্রিম।
বছর দশেক বাদে সেই টেঁপির চোখে আইলাইনার, ট্যাঁপার হাই-পাওয়ার চশমা। মেলায় টেঁপি খোঁজে জাঙ্ক জুয়েলারি, ট্যাঁপা পরশপাথর। মাঝে মাঝে সে মেলায় হারিয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্নে চমকে চমকে ওঠে (মূল কারণ অবিশ্যি চিনেবাদামে অরুচি)। কিন্তু সে উঠতি কবি। প্রেমেন মিত্তির বিধান দিয়েছেন দিশেহারা মাঠে হারিয়ে যেতে। উফ্, কী টানাপোড়েন! ও দিকে টেঁপি ওই একই কাব্য শম্ভু মিত্তিরের গলায় শুনে ফিদা! অবচেতনে শিমুল গাছের ছায়ায় বসে আইসক্রিম খায়।
প্রত্যেক উঠতি কবির জন্য বইমেলা একেবারে বাধ্যতামূলক। এবং লিট্ল ম্যাগাজিনের স্টল। হুড়মুড়িয়ে মেলায় ঢুকে ট্যাঁপা হোঁচট খেল স্ন্যাক্স বার-এ। ‘আচ্ছা, লিট্ল ম্যাগ কোথায় বলুন তো?’ দোকানদার বেদম প্রফেশনাল ‘তা জানি না, তবে মশালা ম্যাগি চান তো দু’মিনিটে।’ বিরক্তি আর গাম্ভীর্য মেশানো মুখ বানিয়ে, আঙুলের টোকায় চশমাটা নাকের ওপর দিকে ঠেলে দিয়ে ট্যাঁপার দৃপ্ত পদক্ষেপে উল্টো দিকে হন্টন। এ দিকে বইমেলার সিজন এলেই টেঁপির মন আনচান। গত এক সপ্তাহে নীললোহিতের ক্র্যাশ কোর্স শেষ করার পর থেকেই নিজেকে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। অগত্যা পাবলিশারকে ফোন ‘উনি কি এখন কলকাতায়?’ ‘না দিক্শূন্যপুর!’ তড়িৎগতিতে হ্যান্ডব্যাগ গুছিয়ে, ঠোঁটে লিপস্টিক ছুঁইয়ে শিয়ালদা ‘একটা দিক্শূন্যপুর’। ‘সেটা কী? লক্ষ্মীকান্তপুর দিতে পারি।’ ‘তাই দিন।’ দেখতে না দেখতে লেডিজ কামরা। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কানের ঝুমকো ভ্যানিশ! তার পর আধ ঘণ্টাটাক হাঁউ-মাঁউ, ঝগড়া-ঝাঁটি, লোকাল ট্রেন, ভোকাল টনিক। পরের স্টেশন, বড় রাস্তা, বাস এবং বইমেলা। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
বিকেল চারটেয় উঠতি কবিদের সংকলনের উদ্বোধন। ট্যাঁপার পাঁচটি পদ্য। তিনটি পড়তে হবে। কোন তিনটি শুনে পাবলিক আহা-বাহা করবে? একটু চিন্তায়। এ দিকে মাইকে অনবরত বেজে যাচ্ছে একই কণ্ঠস্বর ‘মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোনও এক বোধ কাজ করে!’ একটু পরেই ট্যাঁপা বুঝতে পারল, শুধু মাথা নয়, পেটের মধ্যেও কিছু একটা কাজ করে! আর তখন কী কতর্ব্য সেটা একটা নির্বোধেরও জানা উচিত। অতএব বুলেটের বেগে নির্গমন! কিন্তু হায়! প্রতিটি শৌচাগারের সামনে মারফি সাহেব নিজের লোক দাঁড় করিয়ে রেখেছেন এক গণ্ডা করে এবং এদের মুখ দেখলেই বোঝা যায় এক জনও কবির যন্ত্রণা বোঝে না! ছুটতে ছুটতে অবশেষে গিল্ডের অফিস এবং কী আশ্চর্য! কেউ কোত্থাও নেই! একটা আস্ত দোতলা বাড়ি, মায় টেবিল, সোফা, টিভি সমেত ট্যাঁপার দখলে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার উত্তম ব্যবস্থা! সমস্যাটা হল বেরনোর সময়। দোতলার যে উন্মুক্ত দ্বার দিয়ে সগর্বে প্রবেশ করেছিলেন কবি, সেই দ্বার এখন রুদ্ধ কোলাপসিব্ল গেট, দু’টি আখাম্বা তালা! গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো একটি পেল্লায় সাইনবোর্ড আড়াআড়ি দাঁড় করানো আছে গেটের গায়ে। অর্থাৎ বাইরের জগৎ থেকে তুমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, যদি না তারস্বরে চেঁচাও এবং সেটা কেউ শুনতে পায়। কবিতা পাঠ করতে না পারার যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে চিরকাল? তবে যে কোনও যন্ত্রণারই একটি মলম আছে। তাই ট্যাঁপা টেবিলফ্যান ও টিভি অন করে এবং সোফায় গা এলিয়ে দেয়। কিন্তু এ কী টিভিতে ক্লোজ সার্কিটে তাদেরই অনুষ্ঠান! এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী কন্যেটি কে? অনুষ্ঠানের শুরুতেই ঘোষণা ‘আমাদের এক কবিকে হঠাৎই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ওনার জন্য কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করব আমরা।’ ক্যামেরা প্যান করে দর্শকের দিকে, কন্যের মুখের ওপর। চেনা-চেনা-টেঁপি? টেঁপি!
গল্পের শুরুতেই বোঝা যাচ্ছিল ট্যাঁপা ও টেঁপির মিলন অবশ্যম্ভাবী। তবে তা চিরস্থায়ী হবে কিনা তা বলবে সময়। যে প্রেম শুরু হল বইমেলায় হারিয়ে গিয়ে, তা জমাট বাঁধল দুর্গাপুজোর ভিড়ে সপ্তমীর সন্ধ্যেয়। বিকেল থেকে ট্যাঁপা-টেঁপি (এই মুহূতের্ দেব ও দেবী) হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক করেছিল একটাও ঠাকুর দেখবে না কিন্তু শেষ মুহূর্তে টেঁপি বায়না ধরেছে। অগত্যা গড়িয়াহাট-একডালিয়া। যত দূর হাত ধরে আসা যায় তত দূর এসে প্যান্ডেলের কিছুটা আগে পুরুষ-মহিলায় দু’ভাগ হয়ে গেল প্রেম। প্যান্ডেল পেরিয়ে ও পারে গেলে তবে আবার জোড়া লাগবে সাময়িক বিচ্ছেদ (তখন মোবাইল ছিল না)। ছোট বেলা থেকেই বড়সড় কিছু ব্যাপার দেখলে ট্যাঁপার মুখ হাঁ হয়ে যায়। এখানেও সেই একই ফোকাস নিয়ে ঝাড়লণ্ঠন দেখছিল। খেয়ালই করেনি যে ভিড়ের ধাক্কায় এক পাটি চটি নিরুদ্দেশ। যখন বুঝতে পারল, দেরি হয়ে গেছে। ‘দেখি দাদা, সরুন মাসিমা, ভাই একটু সাইড...’ পাবলিকের চাপে দু-চার বার প্যান্ডেল প্রদক্ষিণ করে আধছেঁড়া চপ্পল উদ্ধারের পর যখন ক্লাবের সামনে এসে পৌঁছেছে, তখন সেখানে বিন্দাস ফুচকা সাঁটাচ্ছে টেঁপি আর মাইকে ঘোষণা হচ্ছে ‘বাঁশদ্রোণী থেকে এসেচেন ট্যাঁপা, আপনি যেখানেই থাকুন...’। ট্যাঁপার অবস্থা দেখে প্রিয়তমা হাসতে হাসতে প্রায় মূর্চ্ছা যান। ট্যাঁপা পৌরুষের ড্যামেজ কন্ট্রোলে চেঁচিয়ে ওঠে (কবিদের শোভা পায় না)। রকে বসা কয়েকটা চ্যাংড়া চুটকি ছোঁড়ে ‘অব তেরা কেয়া হোগা রে ডালিয়া!’ মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত একটাও কথা বলেনি ট্যাঁপা। দু’জনে উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করার ঠিক আগে ওর হাতের তালুতে ছোট্ট চুমুূ এঁকে দিয়েছিল টেঁপি, বলেছিল ‘এটা হারিয়ে ফেল না’।
বেশির ভাগ বাঙালির কবিতা লেখার রোগ বা ক্ষমতা যৌবনে একটু থিতিয়ে যায়। যে ট্যাঁপা কৌশোরে বায়রন হতে চেয়েছিল, সে আজ পাড়ার আয়রন ম্যান! সপ্তমীর সকালে তড়িঘড়ি চান। জিন্স। শাটের্র হাতা গুটিয়ে মাস্ল বের করে পাড়ার প্যান্ডেলে এসে ট্যাঁপা শুনল কলাবউ হারিয়ে গেছে! ভোরবেলা গঙ্গাস্নান করাতে গিয়ে এই বিপত্তি। মণ্ডলকাকু চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে চারটে রিং ছেড়ে বললেন ‘ইলোপ!’ ‘কার সঙ্গে?’ ‘সাম আদার গণেশ’। ‘প্রিন্স হেয়ার কাটিং’-এর নাপতে গণেশ ছাড়া অন্য কোনও গণেশকে চেনে না জনতা। অগত্যা বলাইদার বাগানের একটি কলাগাছ থেকে নতুন বউ এলেন। চূড়ান্ত ব্যস্ততায় সারা দিন কেটে গেল। সন্ধেয় ম্যাডক্স স্কোয়্যার। টেঁপি এসেছে।
‘পদ্য?’
‘না সরল গদ্য’।
‘কী লিখেছ?’
‘সেটা মুখে বলতে পারছি না...আমার একটু স্পেস দরকার...তাই’।
‘স্পেস চাইলে রকেটে চেপে পড়লেই পারো’।
টেঁপির ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। ট্যাঁপা হাসে না। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই কয়েকটা কাগজের টুকরো পপকর্নের সঙ্গে মিশে ঘাসের ওপর এসে পড়ে। একটা নতুন শাড়ি, ঝুমকো, ভ্যানিটি ব্যাগ, নিউ মার্কেটে এক ঘণ্টা যুদ্ধ করে কেনা হাল ফ্যাশনের জুতো ভিড়ের মধ্যে নিঃশব্দে হারিয়ে যায়। ট্যাঁপা কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করে, মাটির ভাঁড়ে চা খায়। চা-ওলাকে পাঁচ টাকার নোট-টা রেখে দিতে বলে। চোখ চলে যায় প্যান্ডেলে। এক কোণে ঘোমটা টেনে কলা বউ। চেনা চেনা লাগছে না? ধুস্!
অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। একডালিয়া, ম্যাডক্স স্কোয়্যার অনেকটা একই রকম। কিন্তু বইমেলা পাল্টে গিয়েছে। ট্যাঁপা মিলনমেলায় আসতে চায় না। ওই নামটাতে ওর ঘোর আপত্তি। যে মেলায় হারিয়ে যাওয়া যায় না, সেখানে গিয়ে কী লাভ! বইমেলার দিনগুলোতে সে কবিতা পড়ে। প্রেমেন মিত্তির সরিয়ে জীবনানন্দ টেনে নেয়, আবার বছর কুড়ি পরে। আর ওই মুহূর্তে, নিতান্ত কাকতালীয় ভাবেই, পৃথিবীর কোনও এক প্রান্ত থেকে টেঁপি ফেসবুক-এ আপলোড করে শম্ভু মিত্তিরের গলায় ওই কবিতারই আবৃত্তির লিংক! |
|
|
|
|
|