এই ছিল এই নেই হারিয়েই...
মার ভায়রা দারুণ লোক। ওদের কলকাতার বাড়িতে বাঁধা চাবিওয়ালা আছে বনমালি। প্রতি দিন সকালে এক বার চাবির গোছা ঝনঝনিয়ে আসে, তার পর গত কাল সে বাড়ি ছাড়ার পর থেকে যাবতীয় আলমারি, ব্রিফকেস, সুটকেস, অ্যালুমিনিয়ামের ছোট ইশকুলের বাক্স, যাতে গরম মশলা, ডালের বড়ি, পাঁপড় আর ঠাকুরের একটা ছবি রাখা আছে, সব কিছুর চাবি বানাতে বসে। রোজকার কাজ, মিনিটে মিনিটে চা দিয়ে যায় রান্নার লোক। আগে চুরি করে সংসার চালাত, এ বাড়ির খবর পাওয়া এস্তক দেখেছে চাবি বানিয়ে লাভ অনেক বেশি। ওকে দিয়েই নারকেল পাড়ানো হয় পালাপার্বণের সময়, কুয়োয় বাটিঘটি পড়ে গেলেও দড়ি বাঁধা আঁকশি নামিয়ে সে সব উদ্ধার করতে হয় ওকেই। বাড়ির চিন্তাশীল ব্যক্তিরা রাতের খাওয়ার পর এঁটো হাতে টেবিল ছাড়ার আগে রোজই নানা রকম বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। গোটা বাড়ির যাবতীয় চাবির দায়িত্ব এক বার এক পিসতুতো ভাইকে দেওয়া হল। বি কম পাস, বাড়িতে ইংরিজিতে লেখা কঠিন কঠিন ফাঁ ফোঁ নামওয়ালা বিদেশি থিয়েটারের বই পড়ে আর রাতের খাওয়া সারে আটটার মধ্যে। সে দিন দেখলাম একটা ড্রেসিং গাউন কিনেছে। দু-মিনিট যায়নি সে বেচারা খালি বলে, ‘এই তো একটু আগেই এখানে রেখেছিলাম। কাগ তো নয় যে উড়ে যাবে, আমার চশমাটাই বা কোথায় গেল!’
ঠোক্কর খেতে খেতে সাত-আট জনের সাহায্যে দেওয়াল ধরে ‘বাবু অন্ধা হ্যায়’ গোছের মুখ করে গড়িয়াহাট থেকে চশমার অর্ডার দিয়ে এসে দেখে বনমালি চাবিটাবি বানিয়ে খুকুদির মেয়ের জন্য ফ্যারেক্স গুলছে। সদর দরজায় ইয়েল লক ছাড়াও তিনটে পেল্লায় তালা, বাইরে কোলাপসিব্ল-এ আরও দুটো। এতদসত্ত্বেও মেজদি ঘরে দুটো চাইনিজ তালা লাগিয়ে ইশকুলে পড়াতে যায় কী না, খাটের তলায় বেসিক ট্রেনিংয়ে শেখা তিরিশ রকমের আচারের বয়াম ছিল, এক দিন ফিরে দেখে বাড়িসুদ্ধ লোক হাসি হাসি মুখে হাত চাটছে আর পেন্তির মা কলতলায় বয়াম মাজছে।
ছবি: সুমন চৌধুরী
যাই হোক, আজকাল প্রায় রোজই ফিরে এসেই ‘হ্যাক-স ব্লেড কোথায় গেল, সকালে ইশকুলে যাওয়ার আগে মিটসেফের ওপর ডালের বাটির পাশে গুছিয়ে রেখেছিলাম, এখন দেখছি বাটিতে আমড়ার চাটনি আর সেই প্যাকেটে ধূপকাঠি আর আইসক্রিম খাওয়ার প্লাস্টিকের চামচ, আর সেগুলোর রং সবুজই বা হল কোত্থেকে’ বলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলে বনমালি এক হাতে বুঁচকির মেয়েকে দোল দিতে দিতে কোঁচড় থেকে তা-ও বের করে দেয়। ওর খুব দুঃখ, মেজদি ওকে তালায় হাত দিতে বারণ করেছে। ‘আমার তালার চাবি হারিয়ে যাক, আমায় শ্রদ্ধানন্দ পার্কে বেঞ্চিতে শুয়ে রাত কাটাতে হোক, আমাকে রাস্তার কলে চান করতে হবে বাকি জীবন, সেও ভি আচ্ছা, কিন্তু তুই আমার তালায় হাত দিলে জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবো।’ বনমালি ফোঁত ফোঁত করে আর কাঁধের কাপড়ে চোখের জল মোছে। কারণ বিকেলের এ সময়টায় জেঠিমার উলের গোলা পাকাবার কাজে ওর দু’হাত এনগেজ্ড। ওকে উবু হয়ে বসে দু’হাতে উলের লেচি ধরে থাকতে হয়। সেই গোড়ার দিনগুলো থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। প্রতি হপ্তায় নিয়ম করে গোলা পাকানো হলেও সেগুলো সোয়েটার বোনার সময় কিছুতেই কেন পাওয়া যায় না, কে জানে? অথচ পাড়ার পুজোয় তেকোনা পতাকা টাঙানোর দড়ি বা সি পি এম-এর চেন ফ্ল্যাগ লাগাতে হলে বাড়ির ছেলেপিলেরা ইনভেরিয়েবলি ওই গোলা ব্যবহার করে থাকে। মশারির দড়ি, গোটা পাড়ার পুরুষদের পায়জামার দড়ি এবং বলাইদের ছাগল বাঁধার জন্যও সেই উল। শুধু জ্যাঠামশাইয়ের আর দোলাই থেকে সোয়েটারে উত্তীর্ণ হওয়া হল না। মেনি পিসির ডাক্তার বর বিলেত থেকে ফিরে পেল্লাই এক আলমারি কিনে আনলেন। বাড়ির সব চাবির ডুপ্লিকেট বানিয়ে, তার বিশেষ খোপে সে চাবির গোছা রেখে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে বোঝানো হল চাবি হারিয়ে গেলে কী করতে হবে। সে স্পেশাল আলমারির চাবিও হারাল। পিসেমশাই সে চাবি পকেটে নিয়ে জাহাজে চেপে বিলেত ফেরার সময় এডেন বন্দরে নেমে কাকে একটা ‘ইঁহা সস্তায় জলখাবার কাঁহা মিলেগা বলতে পারতা’ জিজ্ঞেসটিজ্ঞেস করে সেই যে উধাও হলেন, আর কোনও পাত্তাই নেই। তার পর থেকে থানার বড়বাবু প্রতি সন্ধেয় দাবা খেলতে এসে সিঁড়ির নীচে চটিজুতো খুলতে খুলতে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘আহা, পঞ্চাননটা মরে গেল! ও থাকলে এই তালা খোলা কোনও ব্যাপারই না। যাক গে, আপনাদের একটা ফিক্সড ডিপোজিট হয়ে রইল।’ জ্যাঠামশাই গম্ভীর হয়ে বোর্ড সাজাতে সাজাতে বলেন, ‘যা বলেছ সান্যাল, শুধু ডিপোজিশনটা পারমানেন্টলি ফিক্সড। আচ্ছা তুমি কি কাল কয়েকটা বোড়ে পকেটে করে নিয়ে গেছিলে, এই ধরো দুটো কালো আর গোটা পাঁচেক সাদা? কালো মন্ত্রীটাও তো দেখছি নেই। তুমি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আনমাইন্ডফুল হয়ে পড়ছ, ব্রাহ্মী ট্রাই করে দেখতে পারো। শুনেছি কাজ দেয়। আমাদের বাসায় রোজ কেজিখানেক রান্না হয়।’ সান্যাল জেঠু একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘তা হলে আর কাজ দেয় বলছেন কী করে?’
যা-ই হোক, এই নিয়েই আমার ভায়রার বাড়ির লোকজন বেঁচে আছে। শুধু, চিনেমাটির কাপে চা দিলেও প্লেটটা কখনও স্টিলের, তো কখনও কলাই করা হিন্দোলিয়াম-এর। এক সঙ্গে দু’জন গেলে বড় কাঁসার থালায় সাজিয়ে দেয়, এক পাশে কয়েকটা মেরি বিস্কুট। এক সেট কাপ-প্লেট কেউ ও বাড়িতে কখনও খুঁজে পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। বনমালিকে দিয়ে তো আর কাপ-প্লেট বানানো যায় না!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.