|
|
|
|
শাসক-বিরোধী তরজা তুঙ্গে |
মমতা-সুব্রতর ‘জোড়া’ হামলা, তপ্ত বিধানসভা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বিধানসভায় ‘সুস্থ পরিবেশ’ চেয়ে বৃহস্পতিবারই বিরোধী দলনেতার সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন পরিষদীয় মন্ত্রী। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সম্পূর্ণ উল্টো ছবি দেখল বিধানসভা! শাসক-বিরোধী শিবিরের প্রবল তরজায় যেখানে মধ্যমণি হয়ে উঠলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী!
বিধানসভার অধিবেশনের প্রথমার্ধে শুক্রবার একটি বিল নিয়ে বিতর্কে বাম জমানার মন্ত্রী তথা বর্তমান সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমানের বক্তব্যে ‘ক্ষুব্ধ’ হয়ে সেই আলোচনার মধ্যেই মুখ খুলে বিরোধীদের প্রবল আক্রমণ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার মধ্যে ছিল বিরোধীদের ‘চুপ’ করে থাকার ‘পরামর্শ’ও। থাকল এমন মন্তব্যও “আমার রাগ হলে কি আমি আলিমুদ্দিন গিয়ে ভাঙচুর করতে পারি? এত নরকঙ্কাল আপনারা ভুলে গিয়েছেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে আপনাদের অ্যালার্জি হয়েছে! ব্যক্তিগত আক্রমণ করা একটা প্রবণতা, একটা অসুখ! হিংসার কোনও ওষুধ নেই!”
বলাই বাহুল্য, মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের সঙ্গে বিধানসভার মূল আলোচনার কোনও সম্পর্ক ছিল না। বিরোধীদের ভাষা ‘সংবিধান-বিরোধী’, ‘কুরুচিকর’ বলেও অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী।
এর পরেই দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় আচমকাই বলতে উঠে রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা কঙ্কাল-কাণ্ডে অভিযুক্ত গড়বেতার বিধায়ক সুশান্ত ঘোষের জন্য তিনি বিধানসভায় ‘দৃশ্যদূষণে’র শিকার হচ্ছেন! বিরোধী বেঞ্চের প্রথম সারি থেকে সুশান্তবাবুর আসন সরিয়ে দেওয়ার জন্যও ডেপুটি স্পিকারের কাছে আর্জি জানান সুব্রতবাবু।
শাসক পক্ষের এই জোড়া হামলায় স্বভাবতই অত্যন্ত ‘ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত’ বিরোধী শিবির। সভায় প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশিই সিপিএম বিধায়ক আনিসুর পরে বলেন, “আমাদের ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের ব্যাপার নয়। মুখ্যমন্ত্রীর এমন আচরণে পশ্চিমবঙ্গেরই ক্ষতি হবে। মুখ্যমন্ত্রীকে আরও উদার হতে হবে। বিরোধীদের কথা শুনতে হবে। কিন্তু উনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। যুক্তিহীন, উল্টোপাল্টা কথা বলছেন! মুখ্যমন্ত্রী সুস্থ না-থাকলে রাজ্যের মানুষ তো রোগী হয়ে পড়বেন!” ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে, শাসক শিবিরের আক্রমণের কড়া প্রতিক্রিয়া দিলেও এ দিনই দুই অর্ধের বিরতিতে স্পিকারের ঘরে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ সংক্রান্ত বৈঠকে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। প্রাক্তন বাম মন্ত্রী আনিসুর, সুভাষ নস্করেরা গিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তব্যের পর শাসক-বিরোধী ‘সুস্থ’ সম্পর্ক কি আর সম্ভব? আনিসুর, সুভাষবাবুদের জবাব, “আশা করব, বিধানসভার সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকবে। আমরা তো আলোচনার পথে থাকার চেষ্টা করছি। এ দিনও গিয়েছি আলোচনায়। সহযোগিতার কথা আমরা বলেই আসছি। রাজ্যের ভাল চেয়ে যে সমালোচনা বিরোধীরা করছেন, সরকারকে তা শুনতে হবে।”
গোলমালের সূত্রপাত এ দিন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি সংশোধনী বিলে আনিসুরের বক্তব্য চলাকালীন। মুখ্যমন্ত্রী তখন সভায় আসেন। বিলে উল্লিখিত অ্যাড-হক কমিটির প্রস্তাব-সহ একগুচ্ছ বিষয়ে আপত্তি তুলে বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তোলেন আনিসুর। তার মধ্যেই তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা ক্ষমতায় আসার পরেই যে ভাবে ‘দলবল’ নিয়ে বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি-তে গিয়েছিলেন, সেটা কি ‘ভাল কাজ’ ছিল? এতেই ক্ষিপ্ত হন মুখ্যমন্ত্রী। আনিসুরের বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্রই স্পিকারের কাছ থেকে ‘অনুমতি’ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, “গণতন্ত্রের পথ সমৃদ্ধ করার জন্য বিধানসভায় তর্ক-বিতর্ক হবে। কিন্তু এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কুৎসাজনক, আপত্তিকর মন্তব্য করা হচ্ছে। এখন বিরোধীর দিকে চলে যেতে হয়েছে বলে অনেকে আমাদের কাজ সহ্য করতে পারছেন না!” তাঁর আরও বক্তব্য, “আপনারা কী করেছেন? বিধায়কদের মাইনে কেটে নিয়েছেন। বিরোধী দলনেতাকে নানা ভাবে হেনস্থা করতেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে যা বলছেন, সব সাজানো খেলা! একটা অংশকে নিয়ে বাংলার সংস্কৃতিকে আপনারা নষ্ট করার চেষ্টা করছেন। খুব দুর্ভাগ্যজনক।” বিরোধীরা প্রবল প্রতিবাদ করছেন দেখে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, “গায়ের জোরে বিধানসভা চলে না! এটা আমার সুযোগ। আপনারা আমার অধিকার কেড়ে নিতে পারেন না। আমি বলি না সব সময়। আমার কথা শুনতেও চান না। অভিযোগের প্রমাণ থাকতে হবে। সাজানো খেলা সাজানোই!”
আনিসুর পরে বলেন, “এই অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী আসছিলেন না। রাজ্যপালের ভাষণ আর বাজেটের দিন ছিলেন। এদিন হঠাৎ চলে এলেন! বিলের মাঝখানে যা বললেন, তা সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরোধী।” তাঁর সংযোজন, “আমি তো ওঁর প্রশংসাই করছিলাম। বৃহস্পতিবার টিভি চ্যানেলে ওঁকে বলতে শুনেছি, হাসপাতালে দলবল নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। ভাল কথা। তা হলে বাঙ্গুরের কাণ্ডটা তো ভাল নয়। উনি অসহিষ্ণু হয়ে পড়লেন!”
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের রেশ কাটার আগেই দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে মন্ত্রী সুব্রতবাবু ডেপুটি স্পিকারের অনুমতি চেয়ে বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে এখানে দৃশ্যদূষণ চলছে। পরিবেশ দফতর একটা আছে, যেখানে বিভিন্ন দূষণের প্রতিকার হয়। এখানে আমার সামনে তাকাতে গেলেই এমন একজনকে দেখতে হয় সুশান্ত ঘোষ, যিনি খুন করেছেন, ডাকাতি করেছেন যাঁকে দেখলেই আমার দৃশ্যদূষণ হয়!” বিরোধীদের হট্টগোলে সুব্রতবাবুর বাকি কথা ভাল করে শোনা যায়নি। ডেপুটি স্পিকারের কাছে যখন বিরোধী শিবিরের একাংশ ধর্না দিচ্ছেন, সুব্রতবাবু তখন বিরোধীদের হাতের মুদ্রায় ‘টাটা’ করে বেরিয়ে যান!
গোলমালের খবর পেয়ে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় সভায় আসতেই বিরোধীরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। স্পিকার তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টায় বলেন, “আমি বিবৃতি পরীক্ষা করে দেখব। অসংসদীয় কিছু বলা হয়ে থাকলে
বাদ দেব।”
বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু কিছু বলার অনুমতি চাইলে স্পিকার প্রথমে বলেন, “আপনি বললে আরও বিতর্ক হবে।” বিরোধীদের লাগাতার দাবিতে সূর্যবাবুকে অবশ্য এক মিনিট সময় দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “সুস্থ ভাবে আলোচনা চলছিল। হঠাৎ মাঝখানে দায়িত্বশীল এক মন্ত্রী যা বললেন, তা সংসদীয় নয়।” স্পিকার আবার বলেন, বিবৃতি পরীক্ষা করে প্রয়োজন হলে তিনি কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেবেন।
মন্ত্রী সুব্রতবাবু পরে ব্যাখ্যা দেন, “এটা বিধানসভা নয়, ওঁর (সুশান্তবাবু) কাছে লজ্জানিবারণী সভা! তবে আমি অসংসদীয় কিছু বলিনি।” আর তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যায়, সুশান্তবাবুকে মানসিক ভাবে ‘দুর্বল’ করে রাখার জন্যই এমন আক্রমণ শানানো হয়েছে। নিজের জেলায় গেলে তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূল সমর্থকেরা বিক্ষোভ করছেন। তুলনায় বিধানসভায় তিনি ‘সুস্থ’ পরিবেশ পাচ্ছেন। তাতে তাঁর ‘আত্মবিশ্বাস’ বাড়ছে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির বিধায়কের কথায়, “এতে দলীয় কর্মীদের উপর আবার আঘাতের পরিকল্পনা করার মনোবল পেয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁকে মানসিক ভাবে দুর্বল করতেই হবে!” |
|
|
|
|
|