কার্গিল যুদ্ধের সময় টাট্রা ট্রাকের উপর বসানো মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার থেকেই পাকিস্তানি হানাদারদের নিশানা করেছিল ভারতীয় সেনা। সেই টেট্রা ট্রাকই এ বার বিরোধীদের নিশানায় এনে ফেলেছে মনমোহন সিংহের সরকারকে।
সেনাবাহিনীতে দীর্ঘ দিন ধরে নিম্নমানের ট্রাক সরবরাহ এবং এ ব্যাপারে ঘুষ দিতে চাওয়া নিয়ে সেনাপ্রধান ভি কে সিংহের অভিযোগ ঘিরে এমনিতেই তোলপাড় চলছে। রাজনৈতিক ভাবে কংগ্রেস তথা কেন্দ্র যখন এই ‘সেনাপ্রধান বনাম সরকার’ বিতর্ক ধামাচাপা দিতে মরিয়া, তখনই কর্নাটকের এক কংগ্রেস নেতার অভিযোগে নতুন করে বিপাকে সনিয়া-মনমোহন-অ্যান্টনি। কংগ্রেসের শ্রমিক নেতা ডি হনুমনথাপ্পার অভিযোগ, টাট্রা ট্রাক কেনার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও ঘুষ নেওয়ার কথা সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ, এ কে অ্যান্টনি জানতেন। তাঁর এই অভিযোগ ঘিরে নতুন করে বিতর্কের ঝড় উঠতে চলেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
তবে বসে নেই সরকার। টাট্রা ট্রাক কেনায় অনিয়ম ও ঘুষ দিতে চাওয়ার অভিযোগ নিয়ে তদন্তে নেমে আজ একটি মামলা দায়ের করেছে সিবিআই। প্রতারণা ও দুর্নীতি দমন আইনে এই মামলা হয়েছে। এর পরেই সিবিআইয়ের সদর দফতরে ডেকে পাঠানো হয় টাট্রা ট্রাক নির্মাণকারী সংস্থা, ভেকট্রা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান রবি ঋষিকে। ব্রিটিশ নাগরিক রবিকে দীর্ঘক্ষণ জেরা করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে এই সংক্রান্ত যে সব ফাইল রয়েছে, সে সবও সিবিআই নিজেদের হেফাজতে নিচ্ছে। দিল্লি, নয়ডা এবং বেঙ্গালুরুর চার জায়গায় তল্লাশিও চালিয়েছেন সিবিআই অফিসাররা।
আজ যিনি নতুন করে কংগ্রেসের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন, সেই হনুমনথাপ্পার দাবি, ২০০৯ সালেই তিনি এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছিলেন। সনিয়ার পরামর্শে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গুলাম নবি আজাদ সেই চিঠিটি অ্যান্টনিকে পাঠান। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে তদন্তের আশ্বাসও দেওয়া হয়। কিন্তু তিন বছর হয়ে গেলেও কিছু হয়নি। সরকারকে বাগে পেয়ে আজ সংসদে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপিও। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক আজ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গুলাম নবির চিঠি পাওয়ার পরের দিনই অ্যান্টনি প্রতিরক্ষা উৎপাদন দফতরের সচিবকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মাধ্যমে টাট্রা ট্রাক সেনাবাহিনীতে সরবরাহ করা হয়, সেই ভারত আর্থ মুভার্স লিমিটেড (বিইএমএল)-এর ভিজিল্যান্স শাখাও এ ব্যাপারে তদন্ত করছে। এ বিষয়ে সিবিআই ও বিইএমএল-এর মুখ্য ভিজিল্যান্স অধিকর্তার মধ্যে চিঠির আদানপ্রদানও হয়েছে।
কী ভাবে আলোচনার বৃত্তে এল টাট্রা ট্রাক? রাজীব গাঁধীর আমলে, ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিইএমএল-এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর জন্য টাট্রা ট্রাক প্রথম কেনা হয়। তার পর কংগ্রেস হোক বা বিজেপি, সব সরকারের আমলেই সেনাবাহিনীর জন্য টাট্রা ট্রাক কেনা হয়েছে। এ দেশে টাট্রার উত্থান রবি ঋষির হাত ধরে। ভেকট্রা গোষ্ঠীর মালিক রবি দিল্লি আইআইটি-র ছাত্র। ভেকট্রার সদর দফতর লন্ডনে। ১৯৮৬ সাল থেকে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ শুরু হয়, তখন থেকেই টাট্রা ভারতের বাজারে পা রাখে।
কিন্তু সত্যিই কি ঘুষ দিয়ে নিম্নমানের ট্রাক চড়া দামে বিক্রি করেছিল টাট্রা?
বিইএমএল-এর প্রধান ভি আর এস নটরাজনের যুক্তি, “গত ২৬ বছর ধরে আমরা টাট্রা থেকে যন্ত্রাংশ কিনে বেঙ্গালুরুতে তৈরি করছি। সাত হাজার ট্রাক সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করা হয়েছে। প্রাক্তন সেনাপ্রধান জে জে সিংহ নিজে এই ট্রাক চালিয়ে সেরা সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। আমরা টাট্রার দুঃখে মরে যাচ্ছি না, কিন্তু সেনার তরফেও কোনও দিন টাট্রা ট্রাক সম্পর্কে কোনও অভিযোগ ওঠেনি।” কোনও দরপত্র বা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যে এই ট্রাক কেনা হয়নি, তা স্বীকার করেও নটরাজনের যুক্তি, “গোটা বিশ্বে কেউ এই ধরনের ট্রাক বানায় না। কারণ এর প্রযুক্তি এতটাই উন্নতমানের। যখন একটি মাত্র সংস্থাই এই ট্রাক বিক্রি করছে, কোনও প্রতিযোগিতা নেই, সেখানে কোনও প্রভাব খাটানোরও প্রয়োজন পড়ে না।”
এখানেই অমত ভি কে সিংহের। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ৭৮৮টি নতুন টাট্রা ট্রাক কেনার বরাত আটকে দিয়েছিলেন। যে বরাতে সিলমোহর বসিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পূর্বসূরি জেনারেল দীপক কপূর। সেনা-সূত্রের খবর, ভি কে সিংহের মত ছিল, রাশিয়া ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে তৈরি উরাল ট্রাকের ক্ষমতা টাট্রার থেকে অনেক বেশি। রুশ সংস্থা উরালাজ ও কলকাতার ব্যবসায়ী জে কে শরাফের মালিকানাধীন মোতিযুগ সংস্থার তৈরি উরাল ট্রাক হলদিয়ার কারখানায় তৈরি হয়। ফোর্ট উইলিয়ামে ইস্টার্ন কম্যান্ডের প্রধান থাকাকালীন এই ট্রাকের ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হন ভি কে সিংহ। তিনি চেয়েছিলেন, সব সংস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতা করে নতুন ট্রাক কেনা হোক।
সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, বিইএমএল-প্রধান যে দাবিই করুন না কেন, তাঁদের সংস্থাকে সব রকম সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যাচ্ছে না। কারণ ফেব্রুয়ারি মাসে বিইএমএল-র সঙ্গে জড়িত অন্য একটি বিষয়েও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, টাট্রা সংস্থার বিরুদ্ধে চেক প্রজাতন্ত্রেও নানা রকম অভিযোগ রয়েছে। টাট্রার তরফে সংস্থার সম্পর্কে যে সব দেওয়া হয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখবে সিবিআই। |