|
|
|
|
|
|
|
নৃত্য সমালোচনা ১... |
|
ওড়িশির ‘পেজ থ্রি’ উড়ান |
বাঁধাধরা সাধনায় হবে না। নিজেকে ভেঙে গড়তে হবে। ওড়িশি
নৃত্যগুরু সুতপা তালুকদার। এই বয়সেও চালাচ্ছেন সেই খোঁজ। লিখছেন সংযুক্তা বসু |
অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল সিনেমায় নায়িকা হওয়ার।
যে সে নায়িকা নয়। নায়িকা হবে নৃত্যশিল্পী। একবার কল্পনা লাজমির সঙ্গে এই রকম একটা চরিত্রে কাজ করার কথা হয়েও শেষ পর্যন্ত হল না।
এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্নের দিকে তাঁর উড়ান চলতেই থাকে। সুতপা তালুকদার। ওড়িশি নৃত্যগুরু। এ বছর যাঁর ‘বেদনৃত্য’ প্রতিষ্ঠানটির রজত জয়ন্তী উৎসব।
সেই সুতপার এখন মনে হয়, রোজ যেমন নানা কারণে পেজ থ্রিতে সিনেমা, বা অন্য সব গান-বাজনার শিল্পী বা মডেলদের ছবি ছাপা হয় ঠিক তেমনি ভাবেই ধ্রুপদী নাচের শিল্পীদের ছবিও ছাপা হোক। তাঁরাও পৌঁছে যান গ্ল্যামারের রোশনাইয়ে।
তাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি ব্রেস্ট ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি। ২০০০ সালে ওই রোগের আক্রমণ হয়েছিল। শেষ কেমোর দু মাস পরে মঞ্চে ‘পারফর্ম’ করেছিলেন। বললেন, “খুব খারাপ ধরনের ক্যান্সার হয়েছিল। ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় ফিরে এলাম। আসলে আমার মধ্যে একটা মেহনতি মানুষ আছে। যে রোগ-শোকের উর্ধ্বে উঠতে পারে। অসুখের সময় বন্ধু, শত্রু ভালভাবে চিনেছি। তৈরি হয়েছে একটা আলাদা জীবনবোধ ওই সময়ই। সেই বোধ নিয়ে এখনও সংগ্রাম করছি নাচের জন্য।”
এই যে যুবরাজ সিংহের ক্যান্সার ধরা পড়ল, অমন প্রতিভাশালী এক জন তরুণ ক্রিকেটার! কী মনে হচ্ছে? ওঁর সঙ্গে আপনার কোনও মিল?
আছে তো। দেখছেন লোকজন সমবেদনা বেশি জানালে ও কী রকম রেগে যায়। অসুখ হয়েছে তো কী? চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। এটাই ওর কাছে বড় কথা। এটাই স্পোর্টসম্যানশিপ। একজন ডান্সার হিসেবে আমারও ওই আহা, উহু পছন্দ ছিল না।
এ-হেন অপ্রতিরোধ্য সুতপার বাড়ির দোতলায় থাকেন আর এক শিল্পী রূপম ইসলাম। একবার তিনি রূপমকে বলেছিলেন, “তোমার গান আর আমার নাচ মিলিয়ে একটা অনুষ্ঠান হলে কেমন হয়?” চমকে উঠে রূপম বলেছিলেন, “সে কী বলছেন, আপনার নাচ, কত শান্ত, সমাহিত। কী করে হয় সেটা?...” কিন্তু সুতপার ভাবনাচিন্তা যে এই রকমই। সৃষ্টির সঙ্গে তাল রেখেই সৃষ্টিছাড়া।
সেই জন্যই তিনি, নৃত্যশিল্পী সুতপা তালুকদার নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের ছাত্রী সুতপা ওড়িশি নাচের মূল আঙ্গিক বজায় রেখেই কোরিওগ্রাফিতে যোগ করতে চাইছেন নিজস্ব রং-রূপ-ভাব-বেশবাস। সুতপার মতে ধ্রুপদী নাচও এক ধরনের মোহিনী বিদ্যা। শরীরী আকর্ষণ এই শিল্পের একটা বড় অঙ্গ। যেটা ঢাকা পড়ে যায়, গোঁড়ামির আড়ালে। সে কারণেই ‘পেজ থ্রি’তে এই নাচের শিল্পীরা জায়গা পান না।
ধ্রুপদী নৃত্যের সঙ্গে পেজ-থ্রি’র চটজলদি গ্ল্যামার? মেলে না কি? “যুগের ধর্মে সেটা মেলাতে হবে,” উত্তর সুতপার। “তাতে ধ্রুপদী নাচের উচ্চতা কমবে না। বরং তা ব্যাপ্তি পাবে। দর্শক সচেতন হবেন। কিন্তু তার জন্যও এক ধরনের সাধনা দরকার।” |
|
আপাদমস্তক রেশম কাপড় মুড়ে, কতগুলো বাঁধা মুদ্রার বাইরে নাচকে আকর্ষণীয় করতে হলে শরীরের কাঠামোটাকেও যোগ-ব্যায়ামে যত্নে তৈরি করতে হয়। সুতপার মতে, “সেটাই বা ক’জন ছাত্রছাত্রী করে?” বলছেন সুতপা। তাঁর কথায়, কিছু দিন নাচ শেখার পর পাড়ায় পাড়ায় স্কুল খুলে ফেলা ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় লক্ষ্য। সিরিয়ালে অভিনয় করা বা রিয়েলিটি শোয়ে ঢুকে পড়া। এ সবও আছে। দীর্ঘদিন ধরে সাধনা করলে তবেই না ‘পেজ থ্রি’তে জায়গা হবে।”
আসল কথা, শিল্পীদের কাছে এত কম টাকা থাকে যে নিজেদের সাধনার প্রতি তাঁরা যত্নশীল হতে পারেন না। রোজগারের দিকটা ভাবতেই হয়। সুতপা অবশ্য বলছেন, “এখন একটা সুবিধে হয়েছে নাচের স্কুল চালানো, অনুষ্ঠান করার জন্য বেশ ভাল অঙ্কের সরকারি অনুদান পাওয়া যাচ্ছে। আমাকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের সচিব জহর সরকার।”
কী করে যাওয়া যায় পেজ থ্রিতে? সুতপার উত্তর, “বিভিন্ন কর্পোরেট আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার সাহায্য নিলে শিল্পীদের জনসংযোগ, আর্থিক অবস্থা সহজ হচ্ছে। পেজ থ্রি’তেও জায়গা পাওয়া যাচ্ছে।”
আপনি নিজেও একজন বর্ষীয়ান ওড়িশি শিল্পী। আপনাকেও তো কাগজের ওই পৃষ্ঠায় দেখা যায় না?
----আমাকেও রক্ষণশীলতা মানতে হয়েছে। এক বার খুব সুন্দর দেখতে সবুজ রঙের একটা কাঁচুলি পরে দূরদর্শনে নেচেছিলাম। তার পর ওড়িশা থেকে গুরুজির একটা ফোন এল যে এই রকম পোশাক পরলে তিনি আর শেখাবেন না। কিন্তু ধ্রুপদী শিল্পেরও আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর দরকার আছে। নাচ যে শেষমেশ উর্বশী বিদ্যা, শরীর যে তার অনেকটাই, ভুললে চলবে কেন?
গেল অক্টোবরে লাতিন আমেরিকার পাঁচটা দেশে শো
হয়েছিল ‘শ্যামা’র। লাস ভেগাসে গিয়ে পড়তে হল মহা ফ্যাসাদে। প্রেক্ষাগৃহে দর্শক আসন ৮০০ আর ১৬২২ জন দর্শক নাম লিখিয়ে গেছেন শো দেখবেন বলে। শেষ পর্যন্ত নাচের দল নিয়ে একই সন্ধ্যায় দু’ দুটো শোয়ের আয়োজন করতে হয়েছিল সুতপাকে।
“‘শ্যামা’ যখন করেছি সেখানেও বজ্রসেন আর শ্যামাকে আমি দূরে দূরে রাখিনি। নাচতে নেমে শরীর ছোঁব না, নারী পুরুষে ঘনিষ্ঠ হব না তা তো হয় না। যখন বজ্রসেন শ্যামাকে প্রত্যাখ্যান করবে তখন শ্যামা তার প্রেমিকের বুকে আমার নৃত্যনাট্যে আছড়ে পড়ে কেঁদেছে। ওই রকম একটা আবেগঘন মুহূতের্র্ ধরি মাছ না ছুঁই পানি দূরত্ব রাখতে পারে না নায়ক-নায়িকা,” সুতপার বক্তব্য।
শুধু শ্যামা নয়। ‘কৃষ্ণভাবমাধুরী’ নৃত্যনাট্যে কৃষ্ণের জন্ম থেকে কুরুক্ষেত্রলীলা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি শিল্পীদের মুখে এঁটেছেন সরাইকেলা মুখোশ, শিল্পীদের পরিয়েছেন অভিনব কাটিংয়ের ওড়িশি পটচিত্র স্টাইলের পোশাক, পুরোহিতেরা পুজোর সময় হাতের যে সব মুদ্রা করেন সে সব এনেছেন নাচের মুদ্রায়, যাতে প্রেমে ঢলঢল মনে হয় প্রত্যেকটা মুহূর্ত আর ভঙ্গি। তাতে রাধাকৃষ্ণ হয়ে গেছেন রক্তমাংসের রসলীলার ন রনারী।
কী ভাবে আধুনিক দেখতে হয়েছে শ্যামা? “এক দিকে ভেঙেছি রবীন্দ্রনৃত্য শৈলী, অন্য দিকে ভেঙেছি ওড়িশি নাচের স্টাইল। দু’য়ে মিলে তৈরি হয়েছে নাচের একটা আলাদা রূপ। পরিয়েছি টিস্যুর পোশাক। না বাটিক, না সাউথ সিল্ক। গয়না? সেও চমকপ্রদ, সবই রঙিন ন্যাকড়া দিয়ে তৈরি। এই রকম ভাবেই এখন ‘মায়ার খেলা’রও কাজ করছি যেখানে নাচের শিল্পীরা মানবিক আবেগের অভিনয় করবে। আর বেশবাসও হবে আলাদা। সব মিলিয়ে একটা ফিজিক্যাল আকর্ষণ থাকবে। তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরের মনে হবে না। আমার মতে যে কোনও ধ্রুপদী নাচকে আধুনিক করে তোলার এটাই একমাত্র উপায়। কোনও ছুৎমার্গ রাখা চলবে না। ‘সেক্সুয়ালিটি’ নাচের একটা খুব সুন্দর জায়গা। নৃত্যনাট্যের সঙ্গীতের দিকটায় রাবীন্দ্রিক রূপের মধ্যে থেকেও এক ধরনের মুক্ত মূর্ছনা তৈরি করেছেন তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। গানের দিক থেকেও আমার দলের ‘শ্যামা’ তেজেনের নিরলস চেষ্টায় স্বতন্ত্র হয়েছে।” বলছেন সুতপা। সাক্ষাৎকারের শেষে কিছুটা অবরুদ্ধ গলায় উদাস ভাবে বললেন, “গ্রুপ নিয়ে কাজ তো অনেক করছি। কিন্তু ক’জন সোলো ডান্সার তৈরি করতে পারলাম? চেষ্টা অনেক করছি। কিন্তু হচ্ছে না। সেই মমতা শঙ্কর, তনুশ্রী শঙ্কর, অলকনন্দা রায় বা সুতপা তালুকদারের নামগুলোই বারবার শোনা যায়। পরের প্রজন্মের নাম শিরোনামে উঠে আসবে কবে?” |
|
|
|
|
|