অনেকটা সেই রূপকথার হাটের মতো।
‘যদি ডাইনে ঘা দেয় কষে, তবে হট্টমেলা বসে
আর ঘা দিলে ঠিক বাঁয়ে, হাটটি ভেঙে যায়!’
হয়তো বাড়ির কোনও খালি গ্যারাজ বা কারও ফাঁকা পড়ে-থাকা ফ্ল্যাটের দালান বা বারান্দা। সেখানেই ঝেড়েঝুড়ে সেজেগুজে চোখ মেলল একটি রঙিন বিপণি। কিংবা ক’টা চেয়ার-টেবিল পেতে বসে গেল জমজমাট রেস্তোরাঁ। সপ্তাহান্তে ওই গ্যারাজ-মালিক বা ফ্ল্যাট-কর্তা ফিরে এলে কিন্তু সেই দোকান বা রেস্তোরাঁ বেমালুম ‘ভ্যানিশ’। গ্যারাজ বা ফ্ল্যাট তখন ফের পুরনো চেহারায়।
শহুরে শপিংমল বা মূল স্রোতের রিটেল-ক্ষেত্রের বাইরে এই মর্জিমাফিক বা সুবিধেমতো গজিয়ে ওঠা ‘হট্টমেলা’র নামই পপ-আপ স্টোর বা রেস্তোরাঁ। হঠাৎ চমক দিয়ে আবির্ভাবের মতোই যা ভুস করে হঠাৎ মিলিয়ে যাবে। ‘গেরিলা স্টোর’ও বলা হয় একে। দুনিয়ার আর পাঁচটা বড় শহরের মতো ক্রমশ কলকাতাতেও নাগরিক জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠছে এই পপ-আপ সংস্কৃতি।
বিজ্ঞাপন-হোর্ডিংয়ের তোয়াক্কা নেই। ‘এসএমএস’ বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ঢ্যাঁড়া পেটানোই ভরসা। ফ্যাশন ডিজাইনার কিরণউত্তম ঘোষ বা একদা দক্ষিণ কলকাতার তাজা রেস্তোরাঁর কর্ত্রী বিবি সরকারের সৌজন্যে ইতিমধ্যে এই পপ-আপ স্বাদ চেখে নিয়েছে কলকাতা। |
বেনিয়াপুকুরে একটি বাড়ির উঠোনে এক রাতের বার্মিজ রেস্তোরাঁ। ছবি: রাসবিহারী দাস |
বেনিয়াপুকুরে চলচ্চিত্রকার-গায়ক অঞ্জন দত্তের বাড়ির উঠোনেও সম্প্রতি একটি রাতের জন্য সেজে উঠেছিল খাঁটি বার্মিজ রান্নার এক ছোট্ট রেস্তোরাঁ। অঞ্জনের স্ত্রী ছন্দা নিজেই তার শেফ। খাস বর্মা মুলুক থেকে এল চা-পাতা, স্টিকি রাইস বা শুঁটকি মাছ গাপ্পি। শহরের যে কোনও রেস্তোরাঁয় অনাস্বাদিত এই মেনুর টানে আগাম বুকিং করে খাইয়েরা ভিড় করেন। স্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে চেনা-জানা কারও ফ্ল্যাটবাড়িতে মাঝেমধ্যেই দু’-তিন সন্ধের জন্য বসছে বিবি-র রেস্তোরাঁও। ফেসবুকে ওই পপ-আপ রেস্তোরাঁর ‘পেজ’-এ খোঁজ নিয়ে লোকে ব্রাজিল, ভূমধ্যসাগরীয় বা গোয়ান রান্না খেতে যাচ্ছে।
কিছু দিন আগে ল্যান্সডাউনে ফ্যাশন ডিজাইনার কিরণের স্বল্পমেয়াদী ‘গেরিলা স্টোর’টিও নজর কেড়েছিল। কিরণ সৃজনের এমন ‘ছোট-ছোট ইনিংসে’ বিশ্বাসী। তাঁর কথায়, “এ যুগে কোনও কিছু নিয়ে কে আর বেশিক্ষণ মাথা ঘামায়? দু’দিনের জন্য চালু হওয়া আনকোরা কিছুর জন্য বরং টানটা স্বতঃস্ফুর্ত। পাকাপাকি দোকান খোলার থেকে এটাই ভাল!”
চৈত্র-সেলের ধাক্কায় যানজটে বছর-বছর ভুক্তভোগী শহরে দু’দিনের হাটের ‘কনসেপ্ট’ অবশ্য আনকোরা নয়। শীতের আগে ময়দানে গরম পোশাকের ভুটানি বাজার বা দূর গাঁয়ের লোকশিল্প মেলাও যথেষ্ট দেখেছে কলকাতা। বিজ্ঞাপন-বিপণনের দুনিয়ার ‘পণ্ডিত’দের মতে, ওই সেকেলে আঙ্গিকেরই পরিশীলিত রূপ এই ‘পপ-আপ’। এখন শহরে সারা বছরই পোশাক, গেরস্থালির সামগ্রী নিয়ে ছোট-বড় প্রদর্শনী লেগেই থাকে। ‘অ্যাডগুরু’ রাম রায়ের কথায়, “এক ছাদের নীচে বই, কম্পিউটার বা যে কোনও পণ্য নিয়েই চলতে পারে পপ-আপের নিরীক্ষা। ধরুন, বিবেকানন্দের ১৫০ বছরে তাঁর সম্পর্কে সব বইপত্র এক জায়গায় এনে কেউ এমন কিছু ভাবলেন।”
মূল ধারার শপিংমল-রেস্তোরাঁ থাকতে এই অন্য আঙ্গিকে কেন ঝুঁকবে কলকাতা?
বিপণন বিশেষজ্ঞ শিলু চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পপ-আপ ভক্তেরা ‘নিশ কাস্টমার’। খোঁজখবর নিয়ে বুকিং করে কোনও অভিজ্ঞ শেফ বা ফ্যাশন ডিজাইনারের সৃষ্টিশীলতার স্বাদ নিতে আসছেন। যা সচরাচর সাধারণ মল-রেস্তোরাঁয় মেলে না।”
একেলে বাঙালি রান্নার দুঁদে শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “অভিজাত ঘরের কিছু বিশেষ রান্না রেস্তোরাঁয় পরতায় পোষাবে না। যেমন, অত্যন্ত তরিবত করে সৃষ্টি মাছের কিছু পদ অর্ডার করলে তখনই দেওয়া সম্ভব নয়। এ সব দুর্লভ ফাইন ডাইনিং পদের কদর করতে আগাম বুকিং নেওয়া পপ-আপ রেস্তোরাঁই ভাল।”
বহু বড়সড় গ্লোবাল ব্র্যান্ডই এখন বিশ্বের বিভিন্ন শহরে অস্থায়ী দোকান খুলে বসছে। সিঙ্গাপুরের নামী রেস্তোরাঁও তার দেশজ খানার প্রসারে শেফদের টিম নিয়ে সংক্ষিপ্ত সফরে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, মস্কো, সিডনিতে ঘুরছে। এ দেশের অন্যতম প্রধান রেস্তোরাঁ-গোষ্ঠীর কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়েরও মত, “ওহ্ ক্যালকাটার মতো কলকাত্তাইয়া রেস্তোরাঁর খাবার চেনাতেও এমন ঝটিকা বিদেশ-সফর কাজে আসতে পারে।”
কোনও নতুন সৃষ্টিকে মেলে ধরতেও অব্যর্থ পপ-আপ মঞ্চ। ফ্যাশন-ডিজাইনার শর্বরী দত্তের মনে পড়ে যাচ্ছে, আজকের পুরুষের বিশেষ পছন্দ রঙিন ধুতিও বছর কুড়ি আগে ঠাট্টার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু শর্বরীর একটি প্রদর্শনীই ধারণাটা ভাঙল। তখন অবশ্য পপ-আপ শব্দটা কলকাতায় চালু হয়নি।
এই নতুন ভাবনার স্পর্ধাকে কুর্নিশ করেই রাম রায় বলছেন, “কেনাকাটায় নাগরিক জীবনের গতে বাঁধা একঘেয়েমি ভাঙতেও পপ-আপের জুড়ি নেই।” |