মৃত্যুর বছর পেরিয়ে গেল। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা তদন্ত করে জানাতে পারলেন না বর্ধমানের খণ্ডঘোষের বাসিন্দা ৪৮ বছরের শর্মিলা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পিছনে সত্যিই চিকিৎসায় গাফিলতি ছিল কি না।
গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া অবস্থায় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শর্মিলাদেবী। পরিবারের লোকজনের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি ক্রমশ সেরে উঠছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক ও ওয়ার্ডের অন্য কর্মীদের গাফিলতিতে সংক্রমণ হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে এর পরে স্বাস্থ্যকর্তাদের দ্বারস্থ হন শর্মিলাদেবীর স্বামী দিলীপ মুখোপাধ্যায়। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য দফতর। গত অগস্টে তদন্ত রিপোর্ট পেশ হওয়ার কথা ছিল। অপেক্ষা করে করে হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ির লোকেরা স্বাস্থ্য ভবনে এসে জানতে পারলেন, রিপোর্ট পেশ হওয়া তো দূরের কথা, কমিটি গঠনেই গণ্ডগোল থাকায় তদন্ত শুরুই হয়নি। আর সে কথা তাঁদের জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেননি কেউ। ‘সুবিচার’ চেয়ে স্বাস্থ্য ভবনে ঘুরে ঘুরে জুতোর শুকতলা খুইয়ে না ফেললে সেটা হয়তো জানতেও পারতেন না তাঁরা।
বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়ার পরে পুরনো তদন্ত কমিটি বাতিল করে সবেমাত্র চলতি মাসে নতুন কমিটি গড়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠে গিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের কাজের গতি নিয়েও। রোগী বা তাঁর পরিবারের অভাব-অভিযোগকে গুরুত্ব দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বার বার দেওয়া হয়েছে, তা নিছকই কথার কথা
|
শর্মিলা মুখোপাধ্যায় |
কি না সেই প্রশ্ন তুলেছেন শর্মিলাদেবীর স্বামী। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আগের তদন্তে কিছু সমস্যা হয়েছিল। বেশ কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়নি, তাই নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা দফতরের তরফে যথেষ্ট ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।”
কেন তদন্ত শেষ করতে পারেনি আগের কমিটি? তার উত্তর খুঁজতে গিয়েও বেরিয়ে এসেছে আর এক অভিনব তথ্য। ওই কমিটির এক সদস্য বলেন, “আমাদের চার সদস্যের কমিটির মধ্যে হাসপাতালের তৎকালীন সুপারও ছিলেন। অথচ মৃতার পরিবারের তরফে ওঁর বিরুদ্ধেও গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযুক্ত নিজেই তদন্ত করবেন, এ কেমন কথা? আমরা সেটা নিয়ে আপত্তি তুলে জানাই যে এই কমিটির পক্ষে তদন্ত করাটা সমীচীন নয়। তার পরে স্বাস্থ্য ভবন কী সিদ্ধান্ত নিল, তা আমাদের জানানো হয়নি।”
কেন অভিযুক্তকেই তদন্ত কমিটিতে রাখা হল? স্বাস্থ্যকর্তাদের জবাব, “ওটা ভুল ছিল। ভুল শুধরে নতুন কমিটি গড়া হয়েছে।”
শর্মিলাদেবীর স্বামী দিলীপবাবুর অভিযোগ, তাঁর স্ত্রী মানসিক রোগী ছিলেন। চিকিৎসকদের সে কথা জানানো সত্ত্বেও তাঁরা বাড়তি কোনও নজর দেননি। আয়াদের দিয়েই ক্ষতস্থান ড্রেসিং করানো হয়েছে দিনের পর দিন। তিনি বলেন, “আমার স্ত্রীর মানসিক সমস্যার জন্য উনি অন্য কারও হাতে খেতে চাইতেন না। তাই ওঁর খাওয়ার সময়ে ওয়ার্ডে ঢোকার জন্য আমি সুপারের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও ওঁর অবস্থার যখন অবনতি হচ্ছে, তখন আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে গেলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখতে আসেননি। স্রেফ জুনিয়র ডাক্তারদের উপরে ভর করে চিকিৎসা চলেছে।”
শর্মিলাদেবীর মৃত্যুর পরেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য দফতর, মানবাধিকার কমিশন, এমনকী জেলা প্রশাসনেরও দ্বারস্থ হন তিনি। এ বিষয়ে ১৯ জুলাই চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য দফতর। ১০ অগস্টের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, চার সদস্যের কমিটি এক দিনও নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বসেনি। দুই সদস্য এক বার কলকাতা থেকে বর্ধমান গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা তদন্তে কী পেলেন বা আদৌ কিছু পেলেন কি না, তা স্বাস্থ্যকর্তারা জানতে পারেননি। বিষয়টি তাই ধামাচাপা পড়েই ছিল। কিন্তু দিলীপবাবু সশরীরে ঘন ঘন স্বাস্থ্যভবন হাজির হয়ে স্বাস্থ্যকর্তাদের দরজায় দরজায় ঘোরা শুরু করতেই বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়।
দিলীপবাবু ঘোরাঘুরি শুরু না করলে কি স্বাস্থ্যকর্তাদের কোনও দিন টনক নড়ত? সেই প্রশ্নেরও জবাব নেই স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে। |