খবরটা এসেছিল বুধবার বিকেল ৫টা নাগাদ। চিকিৎসার গাফিলতিতে কিশোরীর মৃত্যুর অভিযোগ তোলায় জুনিয়র ডাক্তারেরা রোগীর বাড়ির লোকেদের মারছেন।
মিনিট দশেকের মধ্যে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে যাই। রাধারানি ওয়ার্ডের সামনে মোটরবাইক রেখে সংক্রমণ ওয়ার্ডের দিকে এগোতেই দেখি, ২৫-৩০ জন জুনিয়র ডাক্তার (অনেকেরই গলায় স্টেথোস্কোপ) রোগীর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মারপিট করছেন। কলার ধরে ঘুষি মারছেন, ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলেও দেওয়া হয়েছে এক জনকে।
দ্রুত ক্যামেরার শাটার টিপতে থাকি।
আমার সঙ্গে আরও কিছু সাংবাদিক-আলোকচিত্রী বন্ধু ছিলেন। তাঁরাও ছবি তুলতে থাকেন। মারমুখী ডাক্তারদের নজর পড়ে আমাদের দিকে। ‘এখানে কী চাই! ছবি তুলছিস কেন!’ বলতে বলতে ওঁরা আমাদের তাড়া করেন। কয়েক জনের হাতে রড, লাঠি। কয়েক জন আলোকচিত্রী ওঁদের হাতে পড়ে যান। চড়-থাপ্পড় মারা হতে থাকে।
পিছু হটতে হটতেও আমি জুনিয়র ডাক্তারদের তেড়ে আসা আর আলোকচিত্রীদের মারধরের ছবি তুলছিলাম। আট-দশ জন সোজা আমার দিকে তেড়ে আসতে থাকেন। মুখে অকথ্য গালিগালাজ। বিপদ বুঝে আমি পালানোর চেষ্টা করি। এক জন পিছন থেকে জামার কলার ধরে । হাত চেপে ধরে দু’তিন জন। |
এক বেসরকারি হাসপাতালে উদিত সিংহ। -নিজস্ব চিত্র |
আমি ক্যামেরাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিলাম। ডাক্তারেরা সেটা ছিনিয়ে নেন (আলোকচিত্রীদের ছ’টি ক্যামেরা লুঠ হয়েছে)। বারবার বলতে থাকি, ‘আমি তো কোনও পক্ষ নই। নিজের কাজ করছি মাত্র। আপনারা আমার ক্যামেরা কেড়ে নিচ্ছেন কেন?’ জবাব আসে, ‘... বাচ্চা, ক্যামেরা তো ফেরত দেবই না। তোকেও মেরে দেব।’ একটা গলা চিৎকার করে বলে, ‘দে তো আছাড়! ছবি তুলছে!’
এক জনের হাতে ক্যামেরাটা ঝুলছিল। আমি ঝুঁকে সেটা নিতে যেতেই কেউ পিছন থেকে আমায় লাথি মারে। আমি মুখ থুবড়ে পড়ে যাই। পিঠে ব্যাগ ছিল। টান মেরে সেটাও ছিঁড়ে নেয় কেউ। এলোপাথাড়ি লাথি চলতে থাকে। পেটে, পিঠে, বুকে, মুখে... লাথির পর লাথি। পিঠে চাবুকের মতো পড়তে থাকে স্টেথোস্কোপের বাড়ি। এক জন স্টেথো দিয়ে পিছন থেকে গলায় প্যাঁচ দিয়ে টেনে ধরে। কয়েকটা গলায় চিৎকার, ‘...কে মেরে দে। যেন ফিরতে না পারে।’
চোখ অন্ধকার হয়ে আসছিল।
কোনও রকমে দু’হাত দিয়ে স্টেথোর প্যাঁচ খুলে ফেলি। মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। নাকের পাশে অসহ্য যন্ত্রণা। মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে দেখি, রক্তে লাল! লাথির পর লাথি ফুটবলের মতো গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অসহায় ভাবে শুধু মুখ আর বুকটা আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি।
বন্ধুরা কই? আমি কি মরে যাব?
চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। মাথার ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে না তো? এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে না পারলে হয়তো আর বাঁচব না। শেষ শক্তি জড়ো করে কয়েকটা পায়ের ফাঁক গলে হামাগুড়ি... একটু ফাঁকা পেতেই উঠে প্রাণপণ দৌড়। পিছনে কি ওরা তাড়া করছিল? দেখিনি। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বন্ধুরা। ওঁরাই আমায় ধরে জরুরি বিভাগের দোতলায় নিয়ে যান।
তখন প্রায় সন্ধ্যা ৬টা।
কিন্তু জরুরি বিভাগে গিয়েও তো নিস্তার নেই! বাইরে থেকে তখনও মারপিট-চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎই কয়েক জন দৌড়ে এসে খবর দেন, জুনিয়র ডাক্তারেরা জরুরি বিভাগ ঘিরে ফেলেছেন। আমাদের ফের মারতে আসছেন। জরুরি বিভাগের রোগীরা ভয়ে জানলা বন্ধ করে দিতে থাকেন।
হাসপাতালেরই কিছু কর্মী আমায় বলেন, “আপনি লুকিয়ে পড়ুন। নইলে আপনাকে ওরা মেরে ফেলবে।” ওঁরাই কেয়ারটেকারের ঘর খুলে আমায় সেখানে ঢুকিয়ে দেন। বাইরে থেকে লাগিয়ে দেওয়া হয় তালা। বাইরে আমার কয়েক জন বন্ধু জামা-টামা খুলে রোগী সেজে দেওয়ালের পাশে বসে থাকেন।
কিন্তু একা ঘরে আমার আরও বেশি ভয় লাগতে থাকে। ওরা যদি কোনও ভাবে ঢুকে পড়ে, একা পেয়ে আমায় মেরে ফেলবে! আমি চিৎকার করতে থাকি ‘দরজা খুলুন।’ দরজা খুলে দেওয়া হয়। এর পরে প্রায় আধ ঘণ্টা আমি বারান্দাতেই ট্রলিতে শুয়ে ছিলাম। মাথা-নাক দিয়ে রক্ত ঝরেই চলেছে। কিন্তু কোনও ডাক্তার দেখতে আসেনি। শেষে বন্ধুরাই ট্রলি ঠেলে আমায় তিন তলায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। সেখানে মাথায়-নাকে ব্যান্ডেজ করে আমায় ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলা হয়।
কিন্তু ওয়ার্ডে থাকব কার ভরসায়? রাতে তো দায়িত্বে থাকেন জুনিয়র ডাক্তারেরাই। ফের যে তাঁদের আক্রোশ উস্কে উঠবে না, কে বলতে পারে? ওঁদের হাতে আমার নিরাপত্তা কোথায়? বন্ধুদের বলি, ‘এখান থেকে আমায় সরিয়ে নিয়ে চলো।’রাতে বর্ধমান শহরের কাছেই একটি হাসপাতালে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আমায়। মাথায় ছ’টা সেলাই পড়ে, নাকের নীচে চারটে। পাঁজরে চিড়। ভাগ্য ভাল, মাথার সিটি স্ক্যানে কোনও গোলমাল ধরা পড়েনি।
আমার ক্যামেরা আর ব্যাগ ফেরত দেবে কে? |