ক্যামেরা লুঠ ও সাংবাদিকদের মারধরে অভিযুক্ত কোনও জুনিয়র ডাক্তারের গ্রেফতার হওয়া দূরস্থান। উল্টে শয়ে-শয়ে রোগীর চিকিৎসা শিকেয় তুলে দিনভর কর্মবিরতি চালিয়ে গেলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
বুধবার রাতেই অভিনব সিংহ এবং শৌভিক বাগের নামে বর্ধমান থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন সাংবাদিকেরা। পুলিশ সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার জুনিয়র ডাক্তারেরা উল্টে নিরাপত্তার দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করায় পরিস্থিতি ঘোরালো হওয়ার আশঙ্কাতেই কাউকে ধরা হয়নি। বস্তুত, গ্রেফতারি এড়াতেই জুনিয়র ডাক্তারেরা পাল্টা চাপ দেওয়ার রাস্তা নিয়েছেন বলে হাসপাতাল কর্মীদের একাংশের দাবি।
বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ন’টি ধারায় মামলা হয়েছে। তার ৪টি জামিন-অযোগ্য। শীঘ্রই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পুলিশের দাবি, ইন্টার্ন হস্টেলে অভিযুক্ত দুই জুনিয়র ডাক্তারের খোঁজ মেলেনি। সন্ধ্যায় হাসপাতালের ডেপুটি সুপার তাপসকুমার ঘোষ জানান, নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়ায় কর্মবিরতি উঠেছে। বুধবার দুপুরে এক কিশোরীর মৃত্যুর পর গাফিলতির অভিযোগ তোলায় জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মারপিট বাধে মৃতার বাড়ির লোকজনের। তখন ছবি তুলতে গিয়ে আক্রান্ত হন আলোকচিত্রীরা। আনন্দবাজার পত্রিকার আলোকচিত্রী উদিত সিংহ-সহ দু’জন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। |
মারমুখী জুনিয়র ডাক্তাররা। এই ছিল বুধবারের ছবি। - নিজস্ব চিত্র |
এ দিন বিধানসভার বাইরে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তার উপরে আক্রমণ মেনে নেওয়া যায় না।” বিধানসভায় অধিবেশনের শুরুতেই কেশপুরের সিপিএম বিধায়ক রামেশ্বর দোলুই চিৎকার করে বলতে থাকেন, “বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে সাংবাদিকদের উপরে আক্রমণ হয়েছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করছি।” স্পিকার অবশ্য তাতে গুরুত্ব না দিয়ে সভার কাজ শুরু করে দেন।
এ দিন কর্মবিরতির জেরে সকাল থেকেই নাকাল হন রোগী ও তাঁদের আত্মীয়েরা। বিভিন্ন ওয়ার্ড ছিল কার্যত চিকিৎসকহীন। বীরভূমের কুতুবপুর থেকে জরুরি বিভাগে আসা ইয়াকুব শেখ বলেন, “লিভারের অসুখ নিয়ে এসেছি। ডাক্তার নেই। শুধু নার্সেরা ইনজেকশন দিয়ে গিয়েছেন।” সেখানেই পেট ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন অন্ডালের বিনোদ হাড়ি। তাঁর অভিজ্ঞতা, “বুধবার সন্ধ্যা থেকে কেউ দেখতে পর্যন্ত আসেনি।” রাধারানি ওয়ার্ডে বসে কাঁদছিলেন জামালপুরের সান্ত্বনা পাত্র। তাঁর খেদ, “আমার নাতি রাজেশ মাঝি ক্রমে নেতিয়ে পড়ছে। রক্তপরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ আসেনি।” গুসকরার বসতপুর থেকে আট বছরের ছটু লোহারকে নিয়ে আসা বচ্চন লোহারের আক্ষেপ, “মোটরবাইকের ধাক্কায় হাত ভেঙেছে আমার ছেলের। ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও পরীক্ষা হয়নি।”
দুপুরেই বর্ধমান মেডিক্যালের ডেপুটি সুপার বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। আমরা সে কথা বুঝিয়ে বললেও জুনিয়র ডাক্তারেরা মানতে চাইছেন না।” জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বলেছিলেন, বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিশেষত জরুরি বিভাগে প্রচুর সিনিয়র ডাক্তারকে বহাল করা হয়েছে। কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, রোগীরা ভর্তি হতে পারছেন না। অনেকে ফিরে যাচ্ছেন। অধ্যক্ষকে এ কথা জানানো হলে তিনি চিকিৎসক বহাল করেন।”
হাসপাতাল সূত্রের খবর, সুপার অসিতবরণ সামন্ত ঘটনার নিন্দা করায় বুধবার রাতেই তাঁকে প্রায় চার ঘণ্টা ঘেরাও করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সুপার দুঃখপ্রকাশ করার পর ঘেরাও ওঠে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই হাসপাতালে মোতায়েন হয় পুলিশ ও র্যাফ। তবে জুনিয়র ডাক্তারদের বেশির ভাগেরই দেখা মেলেনি। কয়েক জন হাসপাতালে এলেও ওয়ার্ডে যাননি। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, হাসপাতাল সুপার, ডেপুটি সুপারের দফায় দফায় বৈঠক করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। দাবি ছিল, বুধবার তাঁরাও আক্রান্ত হয়েছেন, এই মর্মে সুপারকে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। হাসপাতালে সাংবাদিকদের গতিবিধিও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিকেলে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জুশ্রী রায় বর্ধমান থানায় জুনিয়র ডাক্তারদের উপরে হামলার কথা জানিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তবে তিনি এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি।
মারধরের প্রতিবাদে দুপুরে বর্ধমান শহরে মিছিল করেন সাংবাদিকেরা। জেলাশাসকের দফতরের সামনে ধর্নাতেও বসেন। জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “সাংবাদিকেরা অপরাধীদের গ্রেফতার, খোয়া যাওয়া জিনিস উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন। পুলিশ পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।”
|