ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ কেনায় স্বচ্ছতা আনার জন্যই আলাদা করে একটি কর্পোরেশন তৈরি করেছিল বিগত বাম সরকার। তার কাজকর্মে প্রচুর অস্বচ্ছতা ও অনিয়ম ধরা পড়ল স্বাস্থ্য দফতরের তদন্তে। বুধবার তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তার রিপোর্ট জমা পড়েছে। শীঘ্রই তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দফতরে জমা দেওয়া হবে। টাকা নয়ছয়ের অঙ্কটা বেশ কয়েক কোটি বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। এত বড় মাপের দুর্নীতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কোনও তদন্ত সংস্থাকে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তাঁরা।
পশ্চিমবঙ্গ মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশন লিমিটেড গঠিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। চেয়ারম্যান হন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র। ২০০৯-এর অক্টোবর থেকে ২০১১ সালের অগস্ট পর্যন্ত ওই সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন রাকেশকুমার বৎস। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই কর্পোরেশনের কাজে কিছু অস্বচ্ছতা নজরে আসে। কোথায় কোথায় দুর্নীতি হয়েছে এবং এই ঘটনার জন্য কারা দায়ী, তাঁদের চিহ্নিত করার জন্য ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য দফতরের তদন্তকারীদের বক্তব্য, যাবতীয় আর্থিক নয়ছয় হয়েছে রাকেশকুমারের সময়কালেই। এই আইএএস অফিসার রাজ্য এড্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা স্যাক্স-এর প্রোজেক্ট ডিরেক্টর ছিলেন। সেখানে আর্থিক দুর্নীতি সামনে আসায় তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এ বার মেডিক্যাল কর্পোরেশনে দুর্নীতির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে। কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। আর প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্তবাবু বলেছেন, “তদন্ত করার অধিকার প্রত্যেকের আছে। দেখা যাক, কারা কতটা কী পেয়েছেন।”
মেডিক্যাল কর্পোরেশনে কী রকম দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের তদন্তকারীরা? তাঁদের বক্তব্য, কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। রাজ্য সরকারের ক্ষতি হয়েছে মূলত সাত ভাবে:
•
ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার কাজ নিজে না করে, নিয়ম ভেঙে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থাকে। বেসরকারি সংস্থাকে ‘মিডলম্যান’-এর মতো কাজ করিয়ে কর্পোরেশন ১৯৫৬ সালের কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করেছে।
•
সংস্থা নির্বাচনের জন্য কোনও দরপত্র ডাকা হয়নি।
•
ওই সংস্থা ‘নজরদারি ও সার্ভিস চার্জ’ বাবদ এ পর্যন্ত ২ কোটি টাকা পেয়েছে। কেনাকাটার কাজটা কর্পোরেশন নিজে করলে ওই টাকা খরচ হত না সরকারের।
•
সংস্থাটিকে এ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৪৩ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা। তারা ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ কেনার বরাত দিয়েছে ৪৩ কোটি ২ লক্ষ টাকার। তদন্তকারীদের প্রশ্ন, আগাম কেন বেশি টাকা দেওয়া হল? বাড়তি ১৬ লক্ষ টাকার সুদ পাচ্ছে সংস্থাটি। কেন তা সরকারের তহবিলে আসবে না? বাড়তি টাকা আদায়ই বা হবে কী ভাবে? সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য-কর্তাদের কাছ থেকে কোনওটিরই সদুত্তর মেলেনি বলে তদন্তকারীদের দাবি।
মেডিক্যাল কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে বাকি চারটি অভিযোগ এই রকম:
• বহু সরঞ্জাম কেনা হয়েছে বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। যেমন, এক-একটি ৯ লক্ষ টাকা দরে ‘পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটর’ কেনা হয়েছে ১৬টি। বাজারে অনেক নামি সংস্থাই তা ৭ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে। স্বাস্থ্য দফতরও আগে ওই দামেই এই যন্ত্র কিনেছে। ‘অক্সিজেন কনসেনট্রেটর’ কেনা হয়েছে ১৬১টি। বাজারে দাম ৭০ হাজার। প্রায় ৯৬ হাজার টাকা দরে তা কিনে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪২ লক্ষ টাকা। একটি ‘চাইল্ড কেয়ার কিট’ ও একটি ‘মাদার কেয়ার কিট’ একসঙ্গে দাম দেওয়া হয়েছে ৪৬০ টাকা। এটাই আগে একটি সরকারি সংস্থার কাছ থেকে ৩৮৫ টাকায় কিনত স্বাস্থ্য দফতর। ৪ লক্ষ এই ধরনের ‘কিট’ কিনতে গিয়ে সরকারের ক্ষতির অঙ্কটা কম করেও ৩ কোটি টাকা।
•ভাঙা হয়েছে সরকারি নিয়ম। ৪৫ লক্ষ টাকার বেশি দামের যন্ত্র কিনতে হলে অর্থ দফতরের অনুমতি নিতে হয়। তা না নিয়েই এক-একটি ‘সি-আর্ম হাই মেশিন’ কেনা হয়েছে ৫৬ লক্ষ টাকায়।
• টেন্ডার ডেকেও দরপত্রে সব থেকে কম দর দিয়েছে যে সব সংস্থা, তাদের বরাত দেওয়া হয়নি। উপেক্ষা করা হয়েছে আদালতের রায়ও। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ১০ হাজার ৬৯৬টি ‘ফেটাল ডপলার মেশিন (যা দিয়ে গর্ভস্থ ভ্রূণের শ্বাসপ্রশ্বাস কেমন চলছে বোঝা যায়)’ কিনতে দরপত্র চাওয়া হয়েছিল। কলকাতার একটি সংস্থা প্রতিটির জন্য দর দেয় ২৫০৫ টাকা। কিন্তু ২৮০৯ টাকা দর দিয়েও বরাত পায় দিল্লির একটি সংস্থা। কলকাতার সংস্থাটি এ নিয়ে মামলা করে ও জিতে যায়। তবু আদালতের বারণ উপেক্ষা করে স্বাস্থ্য দফতর দিল্লির সংস্থাটি থেকেই ১০ হাজার ৫৫৩টি যন্ত্র কিনে নেয়। অর্থাৎ সরকারের বাড়তি খরচ ৩২ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। একই ভাবে, ‘ডেলিভারি টেবিল’ কেনার ক্ষেত্রেও হাওড়ার একটি সংস্থা সবচেয়ে কম দর দেওয়া সত্ত্বেও হরিয়ানার একটি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়।
• সর্বশেষ অভিযোগটি হল, রাজ্য সরকারকে অকারণে ভ্যাট ও অন্তঃশুল্ক বাবদ ২১২ লক্ষ ৬৯ হাজার টাকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। কর্পোরেশন নিজে কেনাকাটা করলে যা দিতে হত না।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, রিপোর্টে এই সবের সবিস্তার উল্লেখ রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসার পরেও এখনও কেন মেডিক্যাল কর্পোরেশন ওই সংস্থা মারফতই কেনাকাটা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের অভিযোগ, “স্বাস্থ্য দফতরের কয়েক জন উচ্চপদস্থ অফিসার এখনও ওই বেসরকারি সংস্থাটিকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের যুক্তি, এ কাজে সংস্থাটির খুব ভাল অভিজ্ঞতা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের স্বাস্থ্য দফতরও ওই সংস্থাটির মাধ্যমে কেনাকাটা করেছে। যদিও তদন্তকারীদের পাল্টা বক্তব্য, ওই দুই রাজ্যেও ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা নিয়ে বড়সড় দুর্নীতি সামনে এসেছে। |