পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রান্তিক গ্রাম আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক সময় তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। কিন্তু খাস কলকাতা শহর লাগোয়া হাওড়ার সরকারি হোমেই যে অপুষ্টি ও অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, তা এত দিন ফাইলবন্দি হয়েই পড়ে ছিল মহাকরণে। সম্প্রতি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের এক নথিতে ওই তথ্য উঠে এসেছে।
সমাজ কল্যাণ দফতরের প্রাক্তন সচিব রিনচেন টেম্পোর একটি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে স্বরাষ্ট্র দফতরকে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে সুপারিশ করেছে কমিশন। এবং তাতেই হাওড়ার আন্দুল রোডে ভবঘুরে আবাসে অপুষ্টি ও অনাহারে এক জনের মৃত্যুর কথা সরকারি তরফে স্বীকার করে নেওয়ার উল্লেখ রয়েছে।
গত বছরের ২২ ডিসেম্বর কমিশন ওই রিপোর্ট পাঠিয়েছে মহাকরণে। তাতে স্বাক্ষর করেছেন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন নারায়ণচন্দ্র শীল ও সদস্য সৌরীন্দ্রনাথ রায়।
কী বলা হয়েছে টেম্পোর রিপোর্টে?
কমিশন লিখেছে, আন্দুল রোডের ভবঘুরে আবাস ও লিলুয়ার মহিলা হোম থেকে একের পর এক আবাসিক পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নজরে আসার পরে সমাজকল্যাণ দফতরের তৎকালীন সচিবকে ডেকে পাঠানো হয়। তলব করা হয় সমাজকল্যাণ বোর্ডের অধিকর্তা ও ‘কন্ট্রোলার অফ ভ্যাগর্যান্সি’-কেও। সেই সময় কমিশনকে সচিব যে রিপোর্ট দেন, তাতেই অনাহারে মৃত্যুর কথা লিখিত ভাবে জানানো হয়। টেম্পো বলেছেন, “এটা সত্যি যে বিভিন্ন হোম থেকে আবাসিক, বিশেষ করে মহিলাদের পালিয়ে যাওয়া ঘটনা ঘটেছে। আন্দুল রোডের ভবঘুরে আবাসে একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে যেখানে অনাহারকেই দায়ী করা হয়েছে এবং ওই অপমৃত্যুর পিছনে অপুষ্টি বা অনাহারই যে মূল কারণ, তা-ও জানানো হয়েছে ময়না-তদন্তের রিপোর্টে। এ নিয়ে একটি মামলা (২৮২/১০-১১) রুজু করেছে সমাজ কল্যাণ দফতর।
কেন এই অপুষ্টি?
সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে কমিশন জেনেছে, সারা মাসে এক জন আবাসিকের খাওয়া-দাওয়ার পিছনে সরকারি বরাদ্দ মাত্র ৮৫০ টাকা। অর্থাৎ, দিনে ২৮ টাকা। ওই টাকায় দু’বেলা ভাত-রুটি ছাড়াও সকাল-বিকেলে টিফিন দেন হোম কর্তৃপক্ষ। কী থাকে সেই খাবারের তালিকায়? সমাজকল্যাণ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “দুপুরে ও রাতে ভাত, ডাল, সবজি ছাড়াও সপ্তাহে তিন দিন মাছ দেওয়া হয়। সপ্তাহে এক দিন মাংস দেওয়ার কথাও বলা আছে।” কিন্তু বর্তমান বাজারদরে ২৮ টাকায় কি ওই খাবার দেওয়া সত্যিই সম্ভব? তবে কি ওই খাবারের তালিকা রয়ে গিয়েছে কেবল সরকারি নথিতে?
দিনসাতেক আগেই হাসপাতালে এক জন রোগীর পথ্য বাবদ সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল হাইকোর্ট। সরবরাহকারীরা কী ভাবে মাত্র ৩৭ টাকায় মান ও পরিমাণ বজায় রেখে পথ্য জোগাচ্ছেন, সরকারি কৌঁসুলির কাছে তা জানতে চান বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্ত। কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে ক্ষুব্ধ আদালত রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছেন।
মানবাধিকার কমিশনও বলেছে, আবাসিকপিছু খাওয়া-দাওয়া বাবদ মাসে ৮৫০ টাকা সরকারি বরাদ্দ ও অপুষ্টিতে মৃত্যুর বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ পেয়ে কমিশন নিজে দুই সদস্যের একটি দল পাঠিয়েছিল আন্দুল রোডের ভবঘুরে আবাস ও লিলুয়ার মহিলা হোমে। সেই রিপোর্ট পেয়ে যে তারা যথেষ্টই উদ্বিগ্ন, তা-ও বলা হয়েছে মহাকরণে পাঠানো সুপারিশপত্রে। সেখানেই কমিশন বলেছে, অবিলম্বে আবাসিকদের খাওয়াখরচ বাড়ানো উচিত। এই ব্যাপারে সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব টুকটুক কুমার অবশ্য বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “ওই প্রস্তাব অর্থ দফতরে পাঠানো হয়েছে।”
গোটা রাজ্যে ১০টি ভবঘুরে আবাস আছে। প্রতিটিতে গড়ে আড়াইশো থেকে তিনশো আবাসিক থাকেন। ‘কন্ট্রোলার অব ভ্যাগর্যান্সি’ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, “প্রতি মাসেই আবাসগুলিতে লোকসংখ্যা বাড়ছে। গত চার-পাঁচ মাসে প্রায় ছ’শো ভবঘুরেকে বিভিন্ন আবাসে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে।”
এর ফলে আবাসগুলিতে স্থানাভাবও বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সমাজকল্যাণ দফতরের এক আধিকারিক। তিনি জানান, প্রিজন ম্যানুয়াল-এ এক জন আবাসিককে অন্তত ৪০ বর্গফুট জায়গা দেওয়ার কথা বলা আছে। কমিশনও সুপারিশ করেছে, আবাসগুলির পরিকাঠামো এবং চিকিৎসা পরিষেবা উন্নত করতে হবে। সেই সঙ্গে রক্ষীদের শূন্য পদগুলি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূরণ করতে বলেছে মানবাধিকার কমিশন। |