পরিবর্তনের রক্তদানে উপহারের ছড়াছড়ি
তোমরা আমাদের রক্ত দাও, আমরা তোমাদের হাতঘড়ি দেব!
অথবা চাকা লাগানো স্যুটকেস বা হাল ফ্যাশনের ছাতা।
রক্তদান শিবিরেও ‘পরিবর্তন’।
এত দিন মিলত সিঙ্গাপুরি কলা, ঠান্ডা ডিম আর দু’পিস পাঁউরুটি। এখন দেওয়া হচ্ছে কেক, প্যাটিস, আইসক্রিম। ঘরে ফেরার আগে কখনও প্রেসার কুকার, কখনও ক্যাসারোল। নিদেনপক্ষে স্টিলের থালা-বাটি।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, বিধানসভা ভোটের সময়ে বেশ কিছু দিন রক্তদান শিবির হয়নি। এর ফলে রাজ্যে রক্তের ভাঁড়ার শুকিয়ে উঠেছিল। নতুন সরকার কিছুটা থিতু হয়ে বসার পরে ফের রক্তদান শিবির শুরু হয়েছে। কিন্তু পাল্টে গিয়েছে তার চেহারা-চরিত্র। অভিযোগ, এই সব রক্তদান শিবিরে নানা ধরনের দামি উপহারের প্রলোভনে ‘স্বেচ্ছায়’ রক্তদান আন্দোলনের ঐতিহ্য মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে। ইন্ডিয়ান হেমাটোলজি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক সমীক্ষাতেও ধরা পড়েছে এই তথ্য।
এখন পাড়ার আটপৌরে ক্লাবের রক্তদান শিবিরকে টেক্কা দিচ্ছেন বড় আয়োজকেরা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যার নেপথ্যে রয়েছেন কোনও না কোনও রাজনৈতিক নেতা। তাঁদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে নানা সংস্থা। দুয়ে মিলে রক্তদানি শিবিরে এখন পুরস্কারের বন্যা! পুরস্কার-বিহীন ছোট শিবিরগুলোয় রক্তদাতা পাওয়াই মুশকিল হয়ে উঠছে।
ইন্ডিয়ান হেমাটোলজি ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট স্পষ্টই বলছে, শিবির করে রক্ত সংগ্রহের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ বরাবর পথ দেখিয়ে এলেও সেই ‘সংস্কৃতিতে’ সম্প্রতি ভাটা পড়েছে। ফাউন্ডেশনের পক্ষে নীলেশ কুলকার্নি বললেন, “বছরে এক-আধ বার জাঁকজমক করে রক্তদান শিবির বসিয়ে রক্তদাতাদের হাতে ‘লোভনীয়’ উপহার তুলে দিয়ে যে প্রত্যাশা তৈরি করছেন আয়োজকেরা, তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে পাড়ার ছোট ক্লাবগুলিকে। পুরস্কার নেই বলে রক্তদাতাদের আকাল দেখা দিয়েছে।”
এমনিতে শিবির করে সংগৃহীত রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে জমা দিলে প্রতি রক্তদাতার ‘টিফিন খরচ’ বাবদ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে মেলে ২০ টাকা। বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক হলে ১০ টাকা বেশি। এই বরাদ্দে ডিম-পাঁউরুটি-কলা আর বড় জোর এক গ্লাস দুধের বেশি কী-ই বা দেওয়া যেতে পারে! কিন্তু এই চেনা ‘হিসেব’টাই এখন পাল্টে গিয়েছে।
দিন কয়েক আগে পানিহাটির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির’ করে তৃণমূল। সেই শিবিরে অন্তত শ’খানেক রক্তদাতার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে হাতঘড়ি। পানিহাটিরই ফেরিঘাটে দেওয়া হয়েছে ক্যাসারোল। কামারহাটি ২ নম্বর ওয়ার্ডে রক্তদাতারা পেয়েছেন চাকা লাগানো দামি স্যুটকেস। ব্যারাকপুরে একটি ক্লাব দিয়েছে প্রেসার কুকার। কলকাতার উত্তরে শ্যামবাজারে মিলেছে ইস্ত্রি, বারুইপুরে ‘ব্র্যান্ডেড ব্যাগ’।
পিছিয়ে নেই বামেরাও। হালিশহরে ডিওয়াইএফ রক্তদাতাদের হাতে তুলে দিয়েছে মাটির রবীন্দ্রমূর্তি। তাতে উদ্যোক্তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও রক্তদাতারা খুশি কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। সিপিএমের যুব সংগঠনের রাজ্য সভাপতি আভাস রায়চৌধুরী দাবি করেন, তৃণমূলের আমদানি করা ‘উপহার-সংস্কৃতি’র শরিক তাঁরা নন। তাঁর যুক্তি, “আমাদের রবীন্দ্রমূর্তি দেওয়া আর তৃণমূলের ছাতা-হাতঘড়ি কোনও ভাবেই তুলনীয় নয়। ক্ষমতাসীন দল রক্তদান শিবিরকে দেনা-পাওনার আখড়া করে তুলতে চাইছে।”
পানিহাটির বিধায়ক তৃণমূলের নির্মল ঘোষ অবশ্য এর মধ্যে ‘অন্যায্য’ কিছু দেখছেন না। তাঁর মতে, “রক্তদান জীবনদান। এত বড় দান যাঁরা করছেন, তাঁদের হাতে কিছু না দিলে খারাপ লাগে। তাই ‘রিটার্ন গিফট’ হিসেবেই ঘড়ি দেওয়া হয়েছে। এটাই এখন চালু সংস্কৃতি।” রাজনীতির রং লাগা উদ্যোক্তাদের কাছে পুরস্কার জোগাড় করাও সমস্যা নয়। তাঁদের জন্য হাত বাড়িয়েই রয়েছে নামী-অনামী নানা সংস্থা। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্পাদক ডি আশিস বলছেন, “বেশ কিছু শিবিরে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা, আয়োজকেরা পুরস্কারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কোনও নামী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেই ওই শিবির করছেন। সংগঠকদের সঙ্গে তাদেরও প্রচার হচ্ছে।”
ব্যাপারটা অস্বস্তিতে ফেলেছে স্বাস্থ্য দফতরকে। দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস বলেন, “সরকারি নির্দেশ, স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবিরে কোনও আর্থিক মূল্য বা পুরস্কার দেওয়া যাবে না। তা হলে আর স্বেচ্ছায় রক্তদান কেন?” পুরস্কারের বিনিময়ে রক্তদানের এই সংস্কৃতিতে বিরক্ত চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীও। এর আগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার হিসেবে দীর্ঘ দিন ওই হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের দায় সামলেছেন তিনি। সিদ্ধার্থবাবু বলেন, “রক্তদান শিবিরে পুরস্কার দেওয়া শুরু হলে সাধারণের মধ্যে একটা প্রত্যাশা তৈরি হবে। ছোট শিবিরগুলোয় তখন আর রক্তদাতারা যাবেন কী! আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্লাড ব্যাঙ্কগুলোই।”
ছোট ক্লাব আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর অন্দরমহলে এখন একটাই প্রশ্ন: প্রত্যাশার উর্ধ্বমুখ কোথায় গিয়ে থামবে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.