ডানা ছাঁটা গণতন্ত্রে আঘাত, অভিযোগ বামেদের
‘অকর্মণ্য’ পঞ্চায়েত ভাঙতে আইন সংশোধন চান সুব্রত
ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার কোনও স্তরে ‘অকর্মণ্যতা’ দেখা দিলে তাদের বিরুদ্ধে ‘কার্যকরী’ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এ বার সামগ্রিক ভাবে পঞ্চায়েত আইন সংশোধনের কথাই ভাবছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের কোনও পঞ্চায়েতের কাজকর্ম ‘সন্তোষজনক’ না-হলে দরকারে তা ভেঙে দেওয়ার অধিকার পেতে ৪০ বছর আগে তাঁরই মন্ত্রিত্বে তৈরি পঞ্চায়েত আইনের কিছু ধারা সংশোধনের কথা বলছেন বর্তমান পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
তবে পঞ্চায়েত আইন-সংক্রান্ত এই ভাবনা এখনও ব্যক্তিগত ভাবে তাঁরই বলে এ দিন জানিয়েছেন সুব্রতবাবু। তিনি বলেন, “পুরো বিষয়টাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্য মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদনসাপেক্ষ।” পুরনো পঞ্চায়েত আইন সংস্কারের জন্য তিনি রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে একটি কমিটি করবেন বলেও জানিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে রাজ্য সরকার কোন পথে হাঁটে, তাই এখন দেখার।
সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তি জারি করে রাজ্য সরকার উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বাম পরিচালিত জেলা পরিষদের সভাধিপতিদের আর্থিক ক্ষমতা তুলে দিয়েছে জেলাশাসকদের হাতে। কিন্তু জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়নি। এই নিয়ে প্রবল বিতর্কের মধ্যেই বুধবার পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রতবাবুর কথায় ইঙ্গিত মিলেছে, ‘অচলাবস্থা’ কাটাতে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি বা গ্রাম পঞ্চায়েতের শুধু ডানা ছাঁটলেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে বলে তাঁরা মনে করছেন না। সেই জন্যই পঞ্চায়েত আইন সংশোধনের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
‘অকেজো’ জেলা পরিষদ বা পঞ্চায়েতগুলির হাত থেকে ক্ষমতা নিয়ে প্রশাসনকে দিয়ে কাজ করিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের আগে মানুষকে ‘উন্নয়নের বার্তা’ দেওয়ার যে লক্ষ্য সরকার পক্ষ নিয়েছে, ১৯৭৩ সালের পঞ্চায়েত আইনই তার পথে বাধা হচ্ছে অন্তত এমনই ইঙ্গিত ধরা পড়েছে সুব্রতবাবুর কথায়। রাজ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানায় ওই আইন তৈরির সময়ে সুব্রতবাবুই ছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। কিন্তু বর্তমান পঞ্চায়েতমন্ত্রীর বক্তব্য, “১৯৭৩ সালের পঞ্চায়েত আইন অনুযায়ী যে কোনও জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি বা গ্রাম পঞ্চায়েতকেই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে দিতে হবে। কোনও পঞ্চায়েত ভেঙে দিয়ে ছ’মাসের মধ্যে ভোট করানোর সংস্থান মূল পঞ্চায়েত আইনে রয়েছে। কিন্তু সেই ভোটে হেরে গেলেও মেয়াদ পূর্ণ না-হওয়া ইস্তক জেলা পরিষদ বা পঞ্চায়েতের আগেকার মাথারাই ক্ষমতায় থেকে যাবেন। ফলে, কোনও জেলা পরিষদ আইন মেনে কাজ না-করলেও তা ভেঙে আখেরে লাভ নেই।”
সুব্রতবাবু এ দিন মহাকরণে বলেন, “কোনও পঞ্চায়েত কাজ করবে না অথচ ভোটে হারলেও পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে! এই বিষয়টা এখন আমার নিজেরই হাস্যকর ঠেকছে!” আর তাঁর নিজের তৈরি পুরনো আইনের বিষয়ে বর্তমান পঞ্চায়েতমন্ত্রীর অভিমত, “আসলে এর আগে যখন পঞ্চায়েতমন্ত্রী ছিলাম, তখন তো রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হত না। নিজের তৈরি পুরনো আইন তাই হাতে-কলমে পরখ করার সুযোগ পাইনি।”
সেই সঙ্গে চলতি আইনের আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা তুলেছেন সুব্রতবাবু: l নির্বাচিত প্রতিনিধি ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতেও পুরনো আইন সংশোধন জরুরি। পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্প কার্যকর করতে বিডিও, এসডিও, জেলাশাসকদের অভিজ্ঞতা আরও ভাল ভাবে কাজে লাগাতে হবে। l জেলা পরিষদের স্থায়ী সমিতির সদস্য না-হয়েও কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে থেকে যাওয়ার যে সংস্থান পুরনো আইনে রয়েছে, তারও সংশোধন জরুরি।
বিধানসভাতেও এ দিন তিনটি জেলা পরিষদের ক্ষমতা ‘কাড়া’র বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাবের জবাব দিতে উঠেছিলেন সুব্রতবাবু। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের এক প্রাক্তন বিরোধী দলনেতার চিঠির উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে ‘বিতর্কে’ও জড়িয়ে পড়েন তিনি। ওই চিঠির প্রতিলিপি বিধানসভায় তখনও কাউকে দেওয়া হয়নি। বিধানসভায় বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতেই লিখিত বক্তৃতার বাইরে ওই চিঠিটি পড়ছেন বলে অভিযোগ তোলে বিরোধী শিবির। স্লোগান তুলে হট্টগোলের মধ্যে বাম বিধায়কেরা ‘ওয়াক-আউট’ করার পরে মুর্শিদাবাদের দু’জন কংগ্রেস বিধায়কও অধিবেশন কক্ষের বাইরে চিঠিটির ‘সারবত্তা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র পরে বলেন, “জবাবি বক্তৃতার লিখিত প্রতিলিপি হাতে না-থাকলে আমরা (বিরোধীরা) কী ভাবে বিতর্কে অংশ নেব? সূর্যবাবুর কথায়, “আমরা স্পিকারকে বলেছিলাম, পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রস্তুত না-থাকলে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিন। পরে নিজের বিবৃতি পাঠ করুন। কিন্তু সুব্রতবাবু জবরদস্তি পড়তে থাকলেন।”
স্পিকারের বিরুদ্ধেও কার্যত ‘পক্ষপাতিত্বে’র অভিযোগ এনে আর এক প্রাক্তন পঞ্চায়েতমন্ত্রী তথা সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমান বলেন, “স্পিকারের দেখছি, অসহায় অবস্থা! সরকার পক্ষ বা মন্ত্রীরা নিয়ম না-মানলে কিছু বলা হয় না।” পরে অবশ্য চিঠির প্রতিলিপি বিধানসভায় দেওয়া হয়। তখন বিরোধীরা সেখানে নেই।
কয়েক জন কংগ্রেস বিধায়কও সুব্রতবাবুর জেলা পরিষদ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। সভাকক্ষে অসিত মিত্র দাবি করেন, মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের চার জন সদস্য (তিন জন কংগ্রেসের, এক জন সিপিএমের) পরে বিধায়ক হওয়ায় বেশ কয়েকটি আসন খালি। তাতে উপনির্বাচন হওয়া উচিত। বহরমপুরের বিধায়ক তথা সদ্যপ্রাক্তন মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তী তাঁর আসনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে অভিযোগ করেন, “সিপিএমের আমলেও জেলা পরিষদে উপনির্বাচন হতো না। এখনও হচ্ছে না।” সুব্রতবাবুর যে-চিঠি পড়া নিয়ে বিতর্ক হয়, মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস বিধায়করাও তার বিরুদ্ধে সরব। মনোজবাবু ও রেজিনগরের কংগ্রেস বিধায়ক হুমায়ুন কবির বলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের ওই বিরোধী দলনেতা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তাঁর চিঠিতে বিস্তর অসত্য আছে।”
তিনটি জেলা পরিষদের ‘ডানা ছাঁটা’র সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক’ বলে এ দিনও দাবি করেন সূর্যবাবু ও অন্য বাম শরিকেরা। অধিবেশনে এ দিনই পঞ্চায়েতমন্ত্রীর কাছে বিরোধীদের প্রশ্ন ছিল, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে রাজ্যে বিভিন্ন জেলা কে কোথায় দাঁড়িয়ে। সুব্রতবাবু এ বিষয়ে বিধানসভার বিধি অনুযায়ী নোটিস দিতে বলে দেন। পরে সুব্রতবাবু প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে বিরোধীরা বলেন, পঞ্চায়েতমন্ত্রী জবাব দিলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে পড়ত। সূর্যবাবুর কথায়, “বাম জেলা পরিষদগুলির বিরুদ্ধে কাজে ব্যর্থতার অভিযোগ আনা হলেও সরকারি ওয়েবসাইটই বলছে, কাজের মাপকাঠিতে তারা অনেক এগিয়ে। সর্বাঙ্গীন কাজের নিরিখে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পরিষদ তো রাজ্যে দু’নম্বরে। সেখানে তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণ ২৪ পরগনা একেবারে শেষে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের জেলা পরিষদগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।” রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত সংক্রান্ত নির্দেশের বিরোধিতা করে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও বলেছেন, “পঞ্চায়েতগুলির ক্ষমতা খর্ব করার ইচ্ছা ক্ষমতায় এসেই প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু নানা বিরোধিতায় কয়েক মাস সেই চেষ্টা আটকেছিল। গণতান্ত্রিক সংস্থাকে একক ব্যক্তিত্বের অধীনে আনার এই প্রচেষ্টা সফল হবে কি না, সেটা বুঝে নিতে এখন একটা অ্যাসিড টেস্ট করছেন!”
এর আগে রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের গতি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে পঞ্চায়েতমন্ত্রী কিন্তু বিষয়টি পুরোপুরি পঞ্চায়েতগুলির ‘কার্যকারিতা’র উপরে নির্ভরশীল বলে মন্তব্য করেন। রাজ্যে বেশির ভাগ পঞ্চায়েত এখনও বিরোধীদের দখলে বলে বামেদের বিঁধতে ছাড়েননি সুব্রতবাবু। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে রাজ্যে ‘আশানুরূপ অগ্রগতি’ হয়নি বলে মেনে নিয়েও পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলেন, “বেশির ভাগ পঞ্চায়েত এখনও আপনাদের (বিরোধীদের) দখলে। ওই পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে। এই কাজে গতি আনতে পঞ্চায়েতগুলির দূরদর্শিতা ও দক্ষতা চাই। ১০০ দিনের কাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা দু’টোই পঞ্চায়েতের উপরে নির্ভরশীল।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.