প্রবন্ধ ২...
জীবন= ১/২ মানব +১/২ কাগজ
বিরা যা-ই বলুন না কেন, এপ্রিল নয়, মার্চই হচ্ছে ইদানীং বাঙালিজীবনের পক্ষে কঠোরতম মাস। কেন! নিজেদের দিকে তাকালেই তা টের পাবেন। যে রাষ্ট্রনির্ধারিত উন্নয়নকামী গণতন্ত্রে বসবাস, সেখানে মানুষের দুটো জীবন পাশাপাশি চলে মানবজীবন আর কাগজজীবন। মানবজীবন কী, সে তো আর বলে দিতে হবে না! বসন্ত বাতাসে মন পুড়ছে, আসন্ন গরমের জন্য এসি কেনার ইচ্ছে হানা দিচ্ছে, ছেলেমেয়েরা কথা শুনছে না বলে মাথা গরম হচ্ছে, বাবা-মা কথা বুঝতে পারছে না বলে ছেলেমেয়ে বাইক-বিহারে গিয়ে বাপান্ত করছে এ সবই মানবজীবন। শরীর আর মনের নানা ওঠাপড়া। রামপ্রসাদী গানে আছে না, এমন মানবজমিন রইল পতিত। সেই মানবজমিনকে ঘিরেই তো মানবজীবন। রামপ্রসাদ আর এক জীবনের কথাও লিখেছিলেন, তবিলদারির জীবন। সে জীবনে হিসেব রাখতে হয়। শুধু অন্যের হিসেব নয়, নিজের হিসেব। রামপ্রসাদের সময় তো উন্নয়নকামী রাষ্ট্রনির্ভর গণতন্ত্র বঙ্গদেশে ছিল না। তাই রামপ্রসাদের সময় এত হিসেব দাখিল করতে হত না। এখন হয়। খেয়াল করবেন, আপনি যত উন্নতি করবেন আপনার এই বিশ্বায়িত গণতান্ত্রিক জীবনে তত কাগজ এসে জমবে। ভোটারস’ আই ডি, পাসপোর্ট, কর্মক্ষেত্রের আই ডি, ব্যাঙ্কের বই, প্যান কার্ড, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এ সবই আসলে নানা রকম কাগজ যা আপনার উন্নত আধুনিক জীবনের অনিবার্য অঙ্গ। এগুলি অনেকেই খুব ভাল সামলে রাখতে পারেন। এগুলো যাতে সামলে রাখা যায়, তার জন্য আবার খাপখোপ বিক্রি হয়। লোকাল ট্রেনে প্যান কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এ সব রাখার জন্য হকারেরা খাপ বিক্রি করেন।
এ সবের সঙ্গে মার্চ মাসে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এসে জোটে আরও আরও কাগজ। যেমন ধরুন ইনকাম ট্যাক্স। আপনি ট্যাক্স বাঁচানোর জন্য নানা খাতে টাকা জমিয়েছেন, তার প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। যাঁরা উচ্চশিক্ষালয়ে মাস্টারি করি, তাঁদের আবার এই মার্চে নানা খতিয়ান দিতে হয়। তার গালভরা নাম অ্যানুয়াল রিপোর্ট। ক’টা লেখা, ক’টা বই, ক’টা পেপার প্রেজেন্টেশন করা হল, তার হিসেব, সঙ্গে প্রমাণপত্র, অর্থাৎ সেমিনারে যে ডাক পেয়েছেন তার চিঠিচাপাটি। এ সব কি হাতের কাছে থাকে! অন্যান্য চাকরিতেও ‘সেল্ফ অ্যাপ্রাইজাল’ দাখিল করতে হয়। এমনিতে বাঙালি কাছাখোলা, তার ওপরে যাঁরা গোপাল ধরনের তাঁদের কথা বাদ দিলে বাকি বাঙালি চিরকালই ন্যালাখ্যাপা। সুতরাং গলদঘর্ম বলে গলদঘর্ম! উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার নাটকে কাপ্তানবাবু এক উদীয়মান নাট্য প্রতিভার নাটকের নানা পাতা নানা জায়গায় ছড়িয়ে ফেলেছিলেন। যেমন তাঁর নাটকের পাতা পাওয়া গিয়েছিল তালতলার চটির তলা থেকে, কোনও অঙ্কের পাতা দিয়ে বানানো হয়েছিল মুড়ির ঠোঙা। অতটা না হোক, ন্যালাখ্যাপা বাঙালির ফর্ম সিক্সটিন হঠাৎ কোনও বইয়ের ফাঁকে মুখ লুকোবে না, তা কি হয়! আবার আমাদের বাবাদের আমলে যা হত, এখনও তা হয়। ফাইলে যে কাগজ চাইছেন, তা পাচ্ছেন না। চাইছেন ২০১১-র এল আই সি দাখিলের কাগজ, উঁকি দিচ্ছে ২০০৮, ২০০৯। তবে সব সময় বাবাদের দোহাই দিয়ে লাভ নেই। বাবা-কাকাদের টাকাপয়সা তুলনায় কম ছিল বলে মাপা হিসেবে চলতেন। কবে দাড়ি কামানোর ব্লেড খুললেন, রান্নাঘরে কবে কয়লা এল বা গ্যাস লাগানো হল লিখে রাখতেন ব্লেডের কাগজে, ক্যালেন্ডারে। এ সব চুকেবুকে গিয়েছে। বিশ্বায়িত বাঙালি বড়লোক হয়েছে বলে কথা। আর নতুন নিয়মের কাগজগুলোও সব সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই যে বসন্তে কাগজ কাগজ করে, ঠিক জায়গায় ঠিক কাগজ রাখব রাখব বলে মাথা চুলকোতে হচ্ছে এটা নিয়ে তামাশা করে লাভ নেই। যে খেলার যে নিয়ম। কাগজ আপনাকে সামলেসুমলে রাখতেই হবে। তবে কিনা এই কাগজের চাপে কাগজের বাইরের মন আর মগজটা যদি মরে যায় তা হলেই বিপত্তি। আসলে খেয়াল করলে টের পাওয়া যায়, কাগজের বাইরে যে একটা জীবনকে আমরা যত্ন করে লালনপালন করি, তা তো নিজেদের স্বার্থেই করি। মন বা মানবজীবন কি আর কাগজের ফ্রেমে আটকে থাকে! আসুন একটা সমঝোতা করি: ১/২ মানবজীবন + ১/২ কাগজজীবন = জীবন।
এ তো একটা আদর্শ, কোন পক্ষে কতটা রাখবেন, তা বরং নিজের নিজের মতো ঠিক করে নিন পরের মার্চের আগেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.