|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
দরিদ্র কে? তার সংজ্ঞাই বা কী? |
গরিব নাকি কমছে? সংসদ উত্তাল। প্রশ্ন আরও। গরিব কে, সেই নির্ণয় আর নেতাদের হাতে থাকছে না।
অতঃপর? নেতারা এলেবেলে হয়ে যাবেন না তো?
অন্য এক মোড় নিচ্ছে রাজনীতি। লিখছেন
স্বাতী ভট্টাচার্য |
গরিবকে নিয়ে ইয়ার্কি করলে নেতারাও রেগে যান। ক’দিন আগে সংসদে রাগ দেখালেন তাঁরা। মাথাপিছু দৈনিক শহরে ২৮ টাকা, আর গ্রামে ২২ টাকার বেশি রোজগার করলে সে গরিব নয়, যোজনা কমিশনের এই হিসেব শুনে জনতা দলের শরদ যাদব বলেছেন, এমন করে গরিব কমানোর চাইতে গুলি করে, বিষ দিয়ে গরিবকে মেরে দেওয়া ভাল। সমাজবাদী পার্টি, ডি এম কে এবং তৃণমূল কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিরাও আপত্তি করেছেন চড়া গলায়। যোজনা কমিশনের কর্তারা ভারতকে বোঝেন না, গরিবকে বোঝেন না, তাই দারিদ্রের এমন অসম্ভব সংজ্ঞা তৈরি করেছেন, এই হল নেতাদের অভিযোগ। চাপে পড়ে প্রধানমন্ত্রী দারিদ্রসীমা আবার বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
কিন্তু দারিদ্রসীমা নিয়ে দরাদরির জন্যই কি এত চেঁচামেচি? নেতারা হয়তো টের পাচ্ছেন যে, এটা কেন্দ্রকে চাপ দিয়ে নিজের রাজ্য বা নির্বাচন ক্ষেত্রের জন্য দু’চার পয়সা বেশি আদায় করার ব্যাপার নয়। আসলে গরিব মানুষের যা বোধ-অনুভব, তার সঙ্গে প্রশাসনের বিচার-বিবেচনার একটা মস্ত ফারাক তৈরি হয়ে যাচ্ছে। অনেক বেশি মানুষ আগের চেয়ে অনেক ভাল আছে, এ কথাটা যোজনা কমিশনের মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া যত জোর দিয়েই বলুন না কেন, ঘর-গেরস্তালিতে তার ছাপ কোথায়? পুকুরের বদলে টিউবওয়েল, খড়ের জায়গায় টিনের চাল, মাঠে না গিয়ে শৌচাগার, গোটা দেশে এই সবের হিসেব নিয়ে শতাংশে আনলে মনে হতে পারে, ‘বাঃ, দেশ এগোচ্ছে।’ কিন্তু ওই পরিবারগুলোর কাছে তা হয়তো অতি সামান্য প্রাপ্তি। বিদ্যুৎহীন রান্নাঘরে যে মেয়েটি সন্ধ্যায় কেরোসিনের কুপি জ্বেলে কুড়িয়ে-আনা কাঠ বা নিজে-হাতে তৈরি ঘুঁটে দিয়ে উনুন জ্বালে (যেমন জ্বালে এ দেশের গ্রামের ৮০ শতাংশ মেয়ে) তাকে শৌচাগার-সাইকেল দেখিয়ে ‘ওই তো উন্নয়ন হয়েছে’ বোঝাতে গেলে চ্যালাকাঠ নিয়ে সে তাড়া করবে। |
|
নেতারা তাই ভয় পাচ্ছেন। নিজেদের মাইনে পাঁচ গুণ বাড়াতে তাঁরা গত বছর সংসদ অচল করেছিলেন তিন দিন। কিন্তু পাঁচটা বাড়তি মানুষকে গরিবের সুযোগ-সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের হাতে আর নেই। গরিবের সংজ্ঞা যত সংকুচিত হচ্ছে, নেতাদের অক্ষমতা আরও মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। বি পি এল-কেন্দ্রিক উন্নয়ন নতুন নয়। কিন্তু নতুন বি পি এল তালিকা হবে, নাম ঢুকবে, এমন একটা আশা জিইয়ে রাখা হত। ইন্দিরা আবাসের টাকা থেকে বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা চারপাশে প্রত্যাশার বাতাবরণ গড়ে রাখা যেত, যা গরিবের কুঁড়ে থেকে নেতার দফতর পর্যন্ত একটা রাস্তা তৈরি করত। এখন যে নিয়ম হচ্ছে, তাতে আধার কার্ড কিছু মানুষকে ‘গরিব’ বলে বৈধতা দেবে, তাদের অ্যাকাউন্ট হবে ব্যাঙ্কে, টাকা আসবে সরাসরি। নেতা দরজা খুলতেও পারবেন না, বন্ধ করতেও পারবেন না। গরিবের কাছে তাঁর দরকার কী তবে?
অনেকে বলবেন, ভালই তো, নেতারা গরিবের নাম করে কোটি টাকা পকেটে পুরবে, তার চেয়ে গরিবের টাকা গরিবের কাছে যাক। কথাটা ভুল নয়, কিন্তু সবটা ঠিকও নয়। রাজনীতি কেবল টাকার জোর, পেশির জোরে হয় না, কোথাও একটা নৈতিক ক্ষমতাও থাকা দরকার। ‘এটাই ঠিক, এটাই ন্যায্য’, এই বিচারগুলো রাজনীতির গোড়ায়, এগুলোকে বাদ দেওয়া যায় না। তাই নেতারা যতই অন্যায় করুন, রাজনীতিতে সামাজিক ন্যায়ের একটা জায়গা থাকে। আর সেখানেই এতদিন গরিবের জোর খাটানোর জায়গা ছিল। সরকারি নির্দেশের পরেও নেতাদের মধ্যস্থতায় গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় কিছু একটা রফা হত। বহু গ্রামে বি পি এল তালিকার বাইরে-পড়া গরিবদের জন্য কিছু কিছু সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা হয়েছে সর্বসম্মতিতে, বিধির বাইরে গিয়ে। পুজো, বা গরিব পরিবারে মেয়ের বিয়ে, বা পার্টি মিটিং-এ রেশন দোকানের চাল বিনা পয়সায় দেওয়াও এর উদাহরণ। নানা মানুষের দাবি ব্যালান্স করার একটা খেলা রাজনৈতিক কর্মীদের বরাবর খেলতে হয়েছে। সেটাই তাঁদের কারও কারওকে নেতা করেছে।
|
নেতার বিড়ম্বনা |
এখন সরকারি সুবিধে পাওয়ার প্রশ্নে গরিবেরও দাবি জানানোর জায়গা নেই, নেতারও দরদস্তুর করার জায়গা নেই। গরিবের উন্নয়ন সম্পূর্ণ প্রকল্প-ভিত্তিক, আর সেই প্রকল্পের শর্ত-পদ্ধতি-গ্রাহক কোনও কিছুই গরিবের গ্রাম-জেলা-রাজ্য স্তরের প্রতিনিধি স্থির করতে পারছেন না। সমাজ উন্নয়নের প্রকল্পগুলি আরও কেন্দ্র-মুখী হচ্ছে। প্রায় সবার অলক্ষ্যে ২০০৫-০৬ সাল থেকে রাজ্য সরকারগুলির প্রাপ্য করের টাকার অঙ্ককে ছাড়িয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় অনুদানে উন্নয়ন প্রকল্পগুলির (‘সেন্ট্রালি স্পনসর্ড স্কিম’) টাকা। রাজ্য সরকারগুলো যখন টাকার অভাবে প্রশাসন চালাতে হিমসিম খাচ্ছে, সেই সময়ে সর্বশিক্ষা অভিযান, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা কিংবা জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের মতো একশোরও বেশি কেন্দ্রীয় প্রকল্পে টাকা ক্রমাগত বেড়েছে। পরিকল্পনার ব্যাপারেও তাই। এক দিকে যোজনা কমিশন, অন্য দিকে জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ, এই দুই হল এখন ভারতের উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরির দুই ইঞ্জিন, দুটোই অ-নির্বাচিত সংস্থা। রাজনীতির জমি দখল করছে ‘টেকনোক্র্যাট’ আমলা-অর্থনীতিবিদরা। কোণঠাসা নেতারা। গরিবের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলেই শুনতে হচ্ছে, ‘ওই তো এতগুলো স্কিমে এত এত টাকা দিয়েছি, আপনারাই তো খরচ করতে পারছেন না।’ কে বলেছিল ওই স্কিম বানাতে, অত টাকা ঢালতে, সে প্রশ্ন কেউ করে উঠতে পারছে না।
নেতাকে কমিশন না দিতে হলে গরিবের খানিক লাভ হয় বটে, কিন্তু উন্নয়ন কেমন করে হবে, তার বিচারে নেতার কথা বলার সুযোগ কমে আসা মানে গরিবের কথার দাম কমে যাওয়া। ভোটের দাম কমে যাওয়া। তাতে গরিবের আরও বড় ক্ষতি। নেতাদের দুর্নীতি গরিবকে বিপাকে ফেলে ঠিকই। তবু তাঁরা ঘুষখোর-লম্পট নেতাকেও ভোট দিয়ে ফিরিয়ে আনেন, যদি মনে করেন তাঁর মাধ্যমে নিজের মতামত, চাহিদা উপরে পৌঁছে দেওয়া যাবে। নেতা যদি এলেবেলে হয়ে যান, গরিবের সে বিপদের কোনও তুলনা নেই।
দেখা যাচ্ছে, এই সংকট থেকে রাজনীতি দু’দিকে মোড় নিচ্ছে। এক, উন্নয়নের প্রত্যাশা তৈরির কারখানা চালু রাখতে নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধের ঘোষণা চালিয়ে যাচ্ছেন নেতারা। যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাষিদের জন্য ‘কিসান ক্রেডিট কার্ড’ কিংবা অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য ‘সামাজিক মুক্তি কার্ড’ ঘোষণা করলেন। এগুলো প্রচলিত প্রকল্পের সঙ্গে ঠিক কী যোগ করবে, ঋণ পেতে বা অনুদান পেতে গরিবের কী ভাবে, কতটা সুবিধে হবে, তা এখনও মিডিয়ার কাছে, গ্রামের মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু যাকে মানুষ ভোট দিয়েছে তার যে মানুষকে কিছু দেওয়ার রয়েছে, সেই দেনা-পাওনার হিসেবটা বজায় রাখতে এগুলো জরুরি। এ খেলায় গরিব জিতবে এমন নয় যা তার পাওয়ার কথা সে হয়তো শেষ পর্যন্ত পাবে না কিন্তু অন্তত খেলার মাঠের বাইরে পড়ে যাবে না। ‘আমার জন্য কী করলে?’ প্রশ্ন করলে তাকে একটা চটজলদি উত্তর দেওয়া যাবে।
অন্য দিকটি আরও ভয়ঙ্কর মোড় ঘুরছে হিংসার দিকে। ‘আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই থাকব?’ এই ক্ষোভ থেকে কখনও ধর্ম, কখনও জাতপাত, কখনও অঞ্চল বা ভাষা, কোনও একটাকে বঞ্চনার কারণ খাড়া করে রাস্তায় নামেন গরিব মানুষ। রাগের কারণের থেকে রাগ প্রকাশের বহর যে অনেকগুণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তার উৎস অন্য খানে। ‘আমার দেশে আমি-ই নেই?’ এই হল তাদের রাগের মূল। মুলায়ম, সুষমা, শরদ যাদব যখন দাবি করেন যে মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া দেশকে চেনেন না, তাঁরা এই কথাটাই হয়তো বলতে চান।
প্রথম ইউ পি এ সরকার এই দেশকে চিনতে পারার দাবি থেকে তার নৈতিক মান্যতা পেয়েছিল। দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার দেশকে চিনতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠল সংসদে, সনিয়া গাঁধীর সামনেই। যোজনা কমিশনের আট শতাংশ দারিদ্র হ্রাসের দাবিতে যেন ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ স্লোগানের প্রতিধ্বনি। ‘তুমি দেশকে যেমন ভাবছ দেশ তেমন নয়,’ ঘুরে-ফিরে আসতে হল সেই পুরনো সতর্কবাণীতে। আর কতবার ভোট দিয়ে গরিবরা নেতাদের দেশ চেনাবেন?
কংগ্রেস নেতারা হয়তো বলতে পারতেন, দারিদ্রসীমা একটা পরিসংখ্যান। এর দরকার উন্নয়নের পরিকল্পনার জন্য, প্রশাসনের মূল্যায়নের জন্য। দারিদ্রমুক্তি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আলাদা, কংগ্রেস দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম আলাদা। কিন্তু তেমন কোনও কণ্ঠ শোনা গেল না। মনমোহন সিংহ যতই দারিদ্রসীমা নিয়ে নতুন করে চিন্তার আশ্বাস দিন, তাঁর আর মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে তফাত কোথায়, স্পষ্ট হচ্ছে না।
ফলে আজ রাজনীতি যেন ন্যায্যতার ভানটুকুও টিকিয়ে রাখতে পারছে না আর। যে দেশে ৭৭ শতাংশ মানুষ গরিব, তার সংসদে ৭৮০ সদস্যের চারশো জনেরও বেশি কোটিপতি সে সত্যটা তো নেতাদের পায়ের তলার মাটি কাটছেই। এখন যদি ‘কে গরিব, কত গরিব’ তা নিয়ে কথা তোলাই না চলে (মন্টেক বলেছেন, দারিদ্রসীমা যা-ই ধরো না কেন, গরিব কমেছে) তা হলে নেতার দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? শরিক হোক আর বিরোধী, সব নেতার নৈতিক জামানত বাজেয়াপ্ত হতে বসেছে। ভারতে রাজনীতির মূলধন যদি হয় গরিবের আস্থা, তবে নেতারা সবাই আজ বি পি এল। |
|
|
|
|
|