স্বতন্ত্র তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে অন্ধ্রপ্রদেশ ও দিল্লির রাজনীতি আবার উত্তাল। লোকসভায় এমন হট্টগোল যে, স্পিকারকে সভার কাজ মুলতুবি করিয়া দিতে হইয়াছে। আর অন্ধ্রপ্রদেশে বিধানসভা তো স্বভাবতই অনেক বেশি কোলাহলমুখর। তেলেঙ্গানা অঞ্চলের জেলাগুলিতে বন্ধ পালিত হইতেছে। পৃথক রাজ্যের দাবিতে সম্প্রতি দুই জন অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়াছেন। পরিস্থিতি উত্তরোত্তর ঘোরালো হইয়া উঠিতেছে। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ, বন্ধ দোকানপাট, যানবাহন, বিপর্যস্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। পৃথক রাজ্য হিসাবে বিবেচিত হওয়ার দাবি তেলেঙ্গানা অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের বাসনা হইলেও তাহা মঞ্জুর করার পক্ষে কোনও যুক্তি নাই। তেলেঙ্গানার বাসিন্দারা অন্যান্য তেলুগুদের হইতে কোনও স্বতন্ত্র ভাষাভাষী নহেন, কোনও স্বতন্ত্র জাতিসত্তাও নহেন। তথাপি অবশিষ্ট অন্ধ্রপ্রদেশ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পৃথক রাজ্যের পরিচয় পাইতে সেখানকার মানুষের আন্দোলনের পিছনে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির সুযোগবঞ্চিত কর্মহীন যুবকদের এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় শঙ্কিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রহিয়াছে। তৎসত্ত্বেও তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি কিন্তু নির্বাচনে কোনও চমকপ্রদ ফল করে নাই, বরং কংগ্রেস এবং তেলুগু দেশমের অনেক রাজনীতিকই এই অঞ্চল হইতে আইনসভায় উপর্যুপরি নির্বাচিত হইতেছেন।
দুর্ভাগ্যবশত, সেই জনপ্রতিনিধিদের গরিষ্ঠ অংশও রাষ্ট্র সমিতির সুরে সুর মিলাইয়া পৃথক রাজ্যের দাবিতে সরব। সম্ভবত স্থানীয় সামাজিক বয়কটের শঙ্কাজনিত চাপ এবং পৃথক রাজ্য গঠিত হইলে সেখানে মন্ত্রিত্বের ক্ষমতা ও তহবিল হস্তগত হওয়ার হাতছানি তাঁহাদের রাষ্ট্র সমিতির আন্দোলনে শামিল হইতে প্ররোচিত করিতেছে। গোলমালটির সূচনা ইউপিএ-১ আমলে, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির সাংসদদের সমর্থন পাইতে কংগ্রেস যখন পৃথক রাজ্যের দাবিটি মানিয়া লওয়ার ইঙ্গিত দিয়াছিল। পরবর্তী কালে কংগ্রেস নেতৃত্ব অবস্থান কঠোর করিলে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি ইউপিএ ছাড়িয়া দেয়। তেলুগু দেশম পার্টি রাজ্যে হৃত গরিমা ফিরিয়া পাইতে সমিতির সমর্থক হইয়া ওঠে। দ্বিতীয় ইউপিএ আমলে অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমের একটি অবিবেচক ঘোষণা পৃথক রাজ্যের দাবিতে নির্বাপিতপ্রায় আন্দোলনকে নূতন করিয়া জাগাইয়া তোলে। তাহার পর মাঝেমধ্যেই এই প্রশ্নে রাজ্য ও দেশের রাজনীতি সরগরম হইতেছে।
তেলেঙ্গানাকে পৃথক রাজ্য মানিয়া লইলে দেশের নানা প্রান্তে যে সব খণ্ডজাতীয়তাবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্বাধিকারপ্রমত্ত হইয়াছে, সেই গোর্খাল্যান্ড, বিদর্ভ, কুর্গ, কামতাপুর, হরিৎ প্রদেশ, বুন্দেলখণ্ড, মরাঠাওয়াড়া ইত্যাদি অসংখ্য জনপদকে নীতিগত ভাবে প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্য মঞ্জুর করার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। ইহা অসম্ভব প্রস্তাব এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসনকে তাহা দৃঢ় ভাবে আন্দোলনকারীদের জানাইয়া দিতে হইবে। সংকীর্ণ ও তাৎক্ষণিক দলীয় স্বার্থ সিদ্ধ করিতে গিয়া দেশের শাসকরা বহু সর্বনাশ সাধন করিয়াছেন। গণতন্ত্রকে গভীরতর করার কিংবা খণ্ডজাতি, জনজাতির ক্ষমতায়নের নামে ইতিমধ্যেই দেশ অনেকগুলি ক্ষুদ্র প্রশাসনিক এককে বিভক্ত, যাহা রাজনীতির জাতীয়তাকে নিয়ত বিপন্ন করিয়া সমগ্রের তুলনায় অংশকে অগ্রাধিকার দিবার অস্বাস্থ্যকর প্রবণতার জন্ম দিয়াছে। সময় আসিয়াছে রাজনীতির সুবিধাবাদী হিসাবনিকাশের বদলে জাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দিবার। |